শুধু ডানা ছাঁটা নয়। গোটা যোজনা কমিশনটাই তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দিল কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাধীন মূল্যায়ন দফতর। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে তাদের সুপারিশ, যোজনা কমিশনের বদলে নতুন একটি সংস্থা তৈরি করা হোক। তার ভূমিকা সীমাবদ্ধ থাকুক কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ক্ষেত্রের অগ্রাধিকার কী হওয়া উচিত, তার রূপরেখা বাতলানোর মধ্যে।
স্বাধীন মূল্যায়ন দফতরের বক্তব্য, যোজনা কমিশন নিজের গণ্ডি পেরিয়ে হয়ে উঠেছে ‘নিয়ন্ত্রণ কমিশন’। ১৯৫০ সালে মন্ত্রিসভার প্রস্তাবে যোজনা কমিশনের সূচনা। সেখানে কমিশনকে শুধু সুপারিশ ও পরামর্শ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রাজ্যগুলির মধ্যে কেন্দ্রীয় সাহায্য বরাদ্দ ও বিভিন্ন মন্ত্রকের বাজেট বরাদ্দের বিষয়ে দিনে দিনে প্রভাব ছড়িয়েছে যোজনা কমিশন। এই ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের সুপারিশ করেছে স্বাধীন মূল্যায়ন দফতর।
এটা বলতে গেলে সরকারেরই অন্তরের কথা। প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার পরেই যোজনা কমিশনের প্রাসঙ্গিকতা কমিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন মোদী। মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়ার পরে নতুন কাউকে কমিশনের উপাধ্যক্ষ পদে বসাননি। বাজেট তৈরির কাজেও পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে কমিশনকে। সরকারের এই দিশায় কার্যত সিলমোহর বসাল স্বাধীন মূল্যায়ন দফতর। ওই দফতরের ডিরেক্টর জেনারেল অজয় ছিব্বেরের সুপারিশ, রাজ্যগুলির জন্য বরাদ্দ নির্ধারণের কাজটি করুক অর্থ কমিশন। কেন্দ্রের মন্ত্রকগুলির মধ্যে বরাদ্দ বণ্টনের কাজটা সরাসরি অর্থ মন্ত্রকই করতে পারে। তার জন্য অর্থ মন্ত্রকে একটি যোজনা দফতর গড়া যেতে পারে।
এমন নয় যে, এই স্বাধীন মূল্যায়ন দফতর মোদী জমানায় তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের আমলে ২০১০-এ এই দফতর তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় মনমোহন-মন্ত্রিসভা। এই দফতর আনুষ্ঠানিক ভাবে কাজ শুরু করে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। কেন্দ্রের উন্নয়ন প্রকল্পগুলি স্বাধীন ভাবে পর্যালোচনা করার দায়িত্ব দিলেও এটিকে রাখা হয়েছিল যোজনা কমিশনের অভিভাবকত্বে। যোজনা কমিশনের উপাধ্যক্ষই ছিলেন এর পরিচালন পর্ষদের প্রধান। এ বার সেই অভিভাবকেরই প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলল স্বাধীন মূল্যায়ন দফতর। তাদের রিপোর্ট বলছে, আধুনিক অর্থনীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে যোজনা কমিশনের সংস্কারের চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তাতে কমিশনের তরফেই বাধা এসেছে। রাজ্যগুলির আর্থিক ক্ষমতায়নেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই কমিশন। অজয় ছিব্বেরের বক্তব্য, “বর্তমান চেহারায় যোজনা কমিশন ভারতের উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু এত বড় সংস্থার সংস্কার করা সহজ নয়। তার বদলে এটিকে তুলে দিয়ে নতুন সংস্থা তৈরিই ভাল। যারা রাজ্যগুলিকে নতুন ধরনের চিন্তাভাবনার জোগান দিয়ে সাহায্য করবে। সংস্কারের পথে দীর্ঘমেয়াদি উপায় বাতলাবে।”
এটা ঘটনা, প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় মনমোহন সিংহও বলেছিলেন, যোজনা কমিশনের ভূমিকায় বদল আনা দরকার। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তেমন কোনও বদল দেখা যায়নি। বরং সরকারের কাজে কমিশনের দাপট বেড়েছে মন্টেকের দৌলতে। অজয় ছিব্বের নতুন যে সংস্থা বা ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ তৈরির প্রস্তাব দিয়েছেন, তার প্রধান কাজ হবে তিনটি।
এক, রাজ্যগুলির মধ্যে উন্নয়ন নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনার আদানপ্রদান। মোদী তাঁর গুজরাত মডেল ব্যাখা করতে গিয়ে এত দিন এই কথাটাই বলে আসছেন। তাঁর বক্তব্য, গুজরাত মডেল আসলে দেশে-বিদেশের সফল মডেলগুলির সমাহার, যেগুলো গুজরাতের চাহিদা অনুযায়ী কাজে লাগানো হয়েছে।
দুই, সামগ্রিক সংস্কারের পথে নতুন চিন্তাভাবনার জোগান দেওয়া।
তিন, নতুন চ্যালেঞ্জকে চিহ্নিত করা এবং সমস্যা তৈরির আগেই তার সমাধান খুঁজে বের করা।
অজয় ছিব্বেরের রিপোর্ট বলছে, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা নন, যোজনা কমিশনে মূলত আমলারা কাজ করেন। তাঁদের পক্ষে এই কাজগুলি করা সম্ভব নয়।
ডানা ছাঁটা শুরু করলেও যোজনা কমিশনের সংস্কারে মোদী কোন পথে এগোবেন, তা এত দিন স্পষ্ট ছিল না। স্বাধীন মূল্যায়ন দফতরের রিপোর্ট হাতে পেয়ে তাঁর কাজটা সহজ হয়ে গেল বলেই মনে করছেন সরকারি কর্তারা। সুপারিশ এলেও, যোজনা কমিশনের মতো পেল্লায় সংস্থাকে তুলে দেওয়ার কাজটা করতে মোদী কতটা সময় নেন, সেটাই প্রশ্ন। অজয় ছিব্বেরের রিপোর্টে অবশ্য কোনও সময়সীমার কথা বলা হয়নি।