দরজা খুলেছে অনেক দিনই। কিন্তু সাড়া নেই। তাই রেলের জন্য বিনিয়োগ ধরতে অস্ট্রেলিয়ায় আসরে নামলেন প্রধানমন্ত্রী।
ক্ষমতায় এসেই রেলে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আনতে দরজা খুলে দিয়েছিল মোদী সরকার। ২৬% বা ৪৯%-এ ধরনের কোনও জটিলতায় না গিয়ে রেল পরিচালন ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রে সরাসরি একশো শতাংশ বিনিয়োগের জন্য বিদেশি সংস্থাকে আহ্বান জানায় সরকার। উদ্দেশ্য ছিল, বিদেশি বিনিয়োগের হাত ধরে রেলের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা। কিন্তু বাজেটের পর ছ’মাস কেটে গিয়েছে। একাধিক বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে মউ স্বাক্ষর করেছে রেলমন্ত্রক। আশ্বাস এসেছে ভূরি ভূরি। কিন্তু বিনিয়োগ আসেনি।
আর তাই বিনিয়োগ টানতে ব্যর্থ হওয়ায় মন্ত্রিসভার প্রথম রদবদলেই তৎকালীন রেলমন্ত্রী সদানন্দ গৌড়াকেও সরিয়েছেন মোদী। নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায় মোদীর সফরসঙ্গী সুরেশ প্রভু। আজ প্রভুর হয়ে ব্যাট ধরলেন মোদী। সিডনিতে নিজের বক্তব্যে মোদী সে দেশের বেসরকারি সংস্থাগুলির কাছে ভারতীয় রেলে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসার আবেদন জানান। মোদীর কথায়, “ভারতীয় রেলে এখন যে কোনও বিদেশি সংস্থা একশো শতাংশ বিনিয়োগ করতে পারে। ভারতীয় রেল একটি বড় বাজার। আমি আশা করছি ভারতের রেল পরিকাঠামোর উন্নতিতে অস্ট্রেলিয়ার সংস্থাগুলি বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসবে।” মোদীর বক্তব্যে স্পষ্ট, ভারতীয় রেলের সার্বিক পরিকাঠামো উন্নতিতে এখন যে ভাবে হোক বিদেশি বিনিয়োগ ধরতে চাইছে সরকার। কারণ, রেলের বর্তমান ঘোষিত প্রকল্পগুলি শেষ করতে প্রয়োজন প্রায় পাঁচ লক্ষ কোটি টাকা। রেল মন্ত্রকের মতে, ওই প্রকল্পের মধ্যে অন্তত আশি শতাংশ আর্থিক ভাবে লাভজনক না হওয়ায় বেসরকারি সংস্থাগুলি ওই প্রকল্পে টাকা লাগাতে অনিচ্ছুক। তাই রেলের হাতে যে সামান্য অর্থ উদ্বৃত্ত রয়েছে তা দিয়েই প্রকল্পগুলি শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রক। ইতিমধ্যেই একশোটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পকে বেছে নিয়ে সেগুলির পিছনে টাকা ঢালার কথা ভাবা হয়েছে। ফলে রেলের হাতে এই মুহূর্তে বুলেট ট্রেন, সেমি হাইস্পিড করিডর, স্টেশনের পরিকাঠামোগত উন্নতি, সিগন্যালিং ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, নিরাপত্তা খাতে খরচ করার জন্য বাড়তি অর্থের জোগান নেই। মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, “ওই প্রকল্পগুলির জন্য দরকার বিপুল অর্থ। মুম্বই-আমদাবাদ বুলেট ট্রেনের জন্যই প্রয়োজন ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এত টাকা সরকারের পক্ষে জোগান দেওয়া অসম্ভব। ফলে ওই প্রকল্পগুলির জন্য বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা নেই রেলের কাছে।”
দরজা খুললেও বাস্তবে বিদেশি বিনিয়োগের দেখা নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীনই সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিতে (পিপিপি মডেল) রেলের কারখানা, লাইন নির্মাণ, স্টেশন উন্নয়নের জন্য নীতি নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই মডেল ডাহা ফেল করে। গত পাঁচ বছরে রেলের বিদেশি তথা বেসরকারি বিনিয়োগ কার্যত শূন্য বললেই চলে। রেল মন্ত্রক বলছে, মূলত দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের প্রশ্নেই পিছিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি সংস্থাগুলি। কারণ ভারতীয় রেলে যে কোনও বড় মাপের প্রকল্পের রূপায়ণে যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করার প্রয়োজন সেই অর্থ কবে বিনিয়োগকারীদের ঘরে আসবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এর পিছনে রেলের যাত্রী ভাড়ায় ভর্তুকি নীতিও অনেকাংশেই দায়ী। কারণ রেল মন্ত্রক ভাড়ার ক্ষেত্রে বড় মাপের ভর্তুকি দিলেও বেসরকারি সংস্থাগুলি তা দিতে নারাজ। আবার ভাড়ায় ভর্তুকি না দিলে আদৌ যাত্রী হবে কিনা তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। যেমন ফরাসি রেলের করা সমীক্ষায় মুম্বই-আমদাবাদ বুলেট ট্রেনের ন্যূনতম ভাড়া ৯০০ টাকার মধ্যে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তা না হলে ওই প্রকল্পের টাকা ঘরে তোলা কঠিন বলেই মত সমীক্ষাকারীদের। এই সমস্যার সমাধান কী ভাবে হতে পারে সেটাই এখন চিন্তার বিষয় রেলের। একই ভাবে যাত্রী নিরাপত্তার জন্য উন্নত মানের প্রযুক্তি ব্যবহার করলে সেই টাকা তুলতে ফের ভাড়া বাড়াতে হবে রেলকে।
রেলের যন্ত্রাংশ নির্মাণের কারখানা গড়তে একাধিক বিদেশি সংস্থা বিনিয়োগে আগ্রহী হলেও তারা চায় রেল বছরে কী সংখ্যায় যন্ত্রাংশ কিনবে সে বিষয়ে নিশ্চিত আশ্বাস দিক। কিন্তু কোনও বিদেশি সংস্থার সঙ্গে এখনই দায়বদ্ধতায় যেতে রাজি নয় রেল। ফলে কিছু সংস্থা এগিয়েও পরে পিছিয়ে গিয়েছে। সিগন্যালিং-র আধুনিকীকরণে কোনও সংস্থা আগ্রহী হলে সে ক্ষেত্রে পরিচালন ব্যবস্থাতেও তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে রেলকে। কিন্তু এ বিষয়ে রেলের নীতিগত সমস্যা রয়েছে।