আরও একটা দিন গেল হট্টগোলেই। ধর্মান্তরণ থেকে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রীর জ্যোতিষে আস্থা এই সব প্রসঙ্গ নিয়ে বিতর্কের ঝড় থামাতে পারছে না সরকার। অথচ বিমা, কয়লা খনির নিলাম ও অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ করানোর জন্য সংসদের চলতি অধিবেশনের আর মাত্র তিনটে দিন হাতে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় এ বার জোড়া রণকৌশল নিল বিজেপি-আরএসএস শিবির। এক দিকে কংগ্রেস জমানার বিভিন্ন নজির তুলে ধরে সনিয়া গাঁধীকে রাজনৈতিক ভাবে আক্রমণ শুরু করল বিজেপি। এরই পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের শাখা সংগঠন ধর্ম জাগরণ মঞ্চ ঘোষণা করল, আপাতত তারা ‘ঘেরা ফেরা’ কর্মসূচি স্থগিত রাখছে। আগরায় ধর্মান্তরণ অনুষ্ঠানের পরে চলতি মাসে উত্তরপ্রদেশের আরও বেশ কয়েকটি জায়গায় ধর্মান্তরণের কর্মসূচি পালনের কথা ঘোষণা করেছিল ওই মঞ্চ।
দিল্লির সভায় সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতির কুরুচিকর মন্তব্য নিয়ে শাসন থেকে দুঃখপ্রকাশ, সবই হয়েছে। কিন্তু সংসদে বিরোধীদের প্রতিবাদ-হইচই তাতে থামেনি। বরং ধর্মান্তরণ অভিযান, বিজেপি নেতাদের নানা মন্তব্যে আরও ঐক্যবদ্ধ হয়েছে বিরোধীরা। তাদের অভিযোগ, ভোট মেরুকরণের অঙ্ক কষেই বিভাজনের রাজনীতি করছে বিজেপি, ঝুলি থেকে বের করে আনছে হিন্দুত্বের কর্মসূচি। ঘটনাচক্রে, জম্মু-কাশ্মীর ও ঝাড়খণ্ডের ভোটপর্ব মেটার পর থেকেই দলের সাংসদদের মুখে লাগাম দেওয়ার, লক্ষ্মণরেখা না পেরোনর ডাক দিচ্ছেন মোদী। তাঁর লক্ষ্য উন্নয়নের কর্মসূচি যেন লাইনচ্যুত না হয়। তবে তার জন্য ঘর সামালানোই যথেষ্ট নয়, রাজ্যসভায় সংখ্যায় এগিয়ে থাকা বিরোধীরা যে কোনও মতেই বিল পাশ করাতে দিতে রাজি নয়, সেটাও মোদীর কাছে স্পষ্ট। বিরোধী ঐক্য ভাঙতে তাই আজ সংসদে সারদা-প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব এনেছিলেন বিজেপির ও শরিক সাংসদরা। এ বার নিশানায় কংগ্রেস।
সরকারের ভাবমূর্তি শোধরানোর পাল্টা কৌশল স্থির করতে আজ সকালে মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে তিনি বলেন, অতীতে কংগ্রেস যা করে এসেছে, সেগুলি করার জন্যই তারা এখন সরকারের নিন্দা করছে। এটা নিছক বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা। বিরোধীদের দাবি মেনে সংসদে কোনও বিবৃতি দিতে আগ্রহী নন মোদী। কারণ, তাতেও থামবে না হাঙ্গামা। তবে মোদী কাল রাজ্যসভায় যাবেন। তার আগে দলের নেতাদের তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, নতিস্বীকারের কোনও প্রশ্ন নেই। কারণ, সরকার কোনও ভুল করেনি। বরং একই ক্ষেত্রে কংগ্রেসের জমানায় কী হয়েছে, সেই বিষয়গুলি তুলে ধরে পাল্টা আক্রমণের পথে হাঁটতে হবে। এর পরই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণে নামে বিজেপি। বিশেষ করে সিলেক্ট কমিটিতে বিমা বিল সমর্থন করেও কংগ্রেস এখন যে ভাবে বাকি বিরোধীদের হট্টগোলে সামিল হয়ে বিল আটকাচ্ছে, তার জন্য সনিয়াকেই দায়ী করছে তারা।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পেয়ে এ দিন আসরে নামেন অরুণ জেটলি, বেঙ্কাইয়া নায়ডু, রবিশঙ্কর প্রসাদের মতো মন্ত্রীরাও। যা-যা নিয়ে কংগ্রেস এখন হট্টগোল করছে, তাদের জমানায় সে সব ক্ষেত্রে কী হতো, তার পাঁচটি নজির তুলে ধরেন তাঁরা।
এক, সনিয়াকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, জওহরলাল নেহরুর ঠিকুজি-কুষ্ঠিতে বিশ্বাস করার কথা। ১৯৪৪ সালে ২৯ অগস্ট পরিবারে নতুন শিশুর জন্মের পর বোন কৃষ্ণাকে নেহরু চিঠি লিখে বলেন, যোগ্য ব্যক্তিকে দিয়ে জন্মছক করিয়ে নিতে। তার জন্য সঠিক ‘সৌর-সময়’ দেওয়ার পরামর্শও দেন তিনি।
দুই, স্কুলে সংস্কৃত পড়ানোর ভাবনা মোদী সরকারের নয়। ইউপিএ জমানায় গত ৭ জানুয়ারি মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে সংস্কৃত বিভাগ খোলার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে বলেছিল। তারও আগে গত বছর সেপ্টেম্বরে লখনউয়ে কংগ্রেসের মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে প্রস্তাব পাশ হয়, দশম শ্রেণি পর্যন্ত সংস্কৃত পড়ানো বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত।
তিন, আইআইটি-তে আমিষ খাওয়া বন্ধ করা নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েছে স্মৃতি ইরানির মন্ত্রক। এটা হয়েছে এপ্রিলে, ইউপিএ জমানায়।
চার, বিজেপি এ-ও মনে করিয়ে দিয়েছে, কংগ্রেস জমানায় মন্ত্রীরা জ্যোতিষীর কথা মেনে নির্দিষ্ট সময়ে দফতরে যেতেন। বাস্তুমতে বদলানো হয়েছে দফতরের আসবাব। হয়েছে চেয়ার পুজোও।
পাঁচ, ২৫ ডিসেম্বর অটলবিহারী বাজপেয়ীর জন্মদিনে ‘সুশাসন দিবস’ পালন নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে বিজেপি আজ সামনে এনেছে রাজীব গাঁধীর জমানায় (১৩ এপ্রিল, ১৯৮৭) মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের একটি চিঠি। তাতে একই ভাবে নবোদয় স্কুলগুলিতে ছুটি বাতিলের নির্দেশ দেয় সরকার।
বেঙ্কাইয়ার কথায়, “সনিয়া গাঁধীর জবাব দেওয়া উচিত, তাঁর পরিবার ও কংগ্রেসের জমানায় এত সব কিছু পালন করা হলেও কেন শুধু বিজেপিকে দুষছেন তাঁরা? কেনই বা এই বাহানায় অচল করে রাখছেন সংসদ?” হাতে থাকা তিন দিনে বিলগুলি পাশ করানোর জন্য বিরোধীদের সঙ্গে ফের আলোচনাও চালাবে সরকার পক্ষ। রাজ্যসভায় আজ হট্টগোলের মধ্যেই বিমান অপহরণ সংক্রান্ত বিলটি পেশ করে সরকার। এ ভাবে বিমা বিলটিও পাশের চেষ্টা হবে। না পারলে বিল প্রত্যাহার করে অর্ডিন্যান্সও আনতে পারে সরকার।