‘খাদ্যরসিক বাঙালি’ তকমাটা বাঙালি কোনও দিনই ছাড়তে পারবেন না। যাবতীয় চব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়-র প্রতিই তার অদম্য ভালবাসাবাসি। গ্রীষ্মের দাহে জেরবার বাঙালি অপেক্ষায় থাকেন, আমের জন্য। রসালো সুমিষ্ট আম যেন গ্রীষ্ম মরসুমের অন্য নাম। বসন্তের শেষ লগ্ন থেকেই বাঙালির আনাজপাতির ঝুড়িতে কাঁচা আমের উঁকুঝুঁকি। আহা কী সুবাস। কচি মুকুল থেকে সে নব্য কিশোর। কী অসামান্য দ্যুতি সে সবুজাভ বর্ণময়তায়।
শুধু বাঙালি কেন, সমস্ত ভারতীয় খাদ্যরসিকদের কাছেই গ্রীষ্মের মরসুম আর আম যেন সমার্থক। বস্তুত এ দেশে আম সুস্বাদু ফল হিসেবে খ্যাত। এ দেশে মোটামুটি মার্চের শেষ থেকে জুলাই পর্যন্তই আমের আনাগোনা চলতে থাকে। কোথাও কোথাও আবার আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্তও আমের দেখাসাক্ষাৎ মেলে। সেই ছাত্র বয়েস থেকেই আমরা শিখে যাই ভারতের জাতীয় ফল আম। জাতীয় পাখি ময়ূর, জাতীয় ফুল পদ্ম এমনতর নানান সাধারণ জ্ঞানের মতই। আরও সাধারণ জ্ঞানের বই ঘেঁটে ছাত্রাবস্থাতেই জানা হয়ে যায় আমের বৈজ্ঞানিক নাম ‘magnifera indica’। প্রদেশ ভেদে এ দেশে নানা জাতের আম পাওয়া যায়। বিভিন্ন আমের প্রজাতির মধ্যে আমাদের বাংলাতেই— মধু কুলকুলি, তোতাপুরী, ফজলি, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, অরুণা, আম্রপালি, সুবর্ণরেখা, মল্লিকা, মিস্রিদানা, নিলাম্বরী, কাঁচামিঠে, কালাভোগ, বারোমাসি, গোলাপখাস, ত্রিফলা, হিমসাগর, ভুতো-বোম্বাই, সরি খাস, চৌষা, মোমফলি, লতানে বোম্বাই— স্বাদে-বর্ণে-গন্ধে তাদের আভিজাত্যই আলাদা।
আবার ‘ফলের রাজা আম’, প্রদেশভেদেও নানান প্রজাতির হয়ে থাকে। প্রতিটি প্রদেশের আমই সেখানকার জলবায়ুর মিশেলে নিজস্ব বিশিষ্টতায়। কোথাও পাকা আমের স্বাদই আলাদা। কোথাও আবার সবজে নধর কাঁচা আমের লা-জবাব স্বাদ। এগুলোরও আবার কোনটা খুব ছোট্ট আকারের কোনওটা বেশ ভারিক্কি ওজনের। তবে প্রতিটা আমেরই কিন্তু আলাদা বনেদিয়ানা আছে কী স্বাদে কী বর্ণময়তায়।
‘বেনারসী ল্যাংড়ার’ খ্যাতি তো বিশ্বনন্দিত। ‘ফলের রাজা আম’—‘আমের রাজা ল্যাংড়া’ (ভিন্ন মতে আলফানসো)। বেনারসে একটা প্রাচীন গল্প খুবই প্রচলিত। বেনারসে এক শতাব্দী প্রাচীন শিবমন্দিরে এক বার জনৈক সাধু বহু দূরদেশ ভ্রমণ করে থাকতে এলেন। শিবমন্দিরের পূজারি তাঁকে থাকার অনুমতিও দেন। সাধুর কাছে একটা আমের চারা ছিল। পূজারির অনুমতি ক্রমে সেই আম্রচারা সাধু মহারাজ মন্দির চত্বরেই রোপণ করেন। নিয়মিত যত্ন, জলসেচনে সে চারা দ্রুত বাড়তে থাকে এবং মাত্র চার বছরের মধ্যেই তাতে মুকুল চলে আসে। অতি সুস্বাদু আমও হয়। সাধু মন্দিরের পূজারিকে বলেন, গাছের প্রথম ফল যেন ওই মন্দিরের শিবলিঙ্গের উদ্দেশে পুজো দেওয়া হয়। এবং সেই ফল কেটে মন্দিরে আগত ভক্তদের প্রসাদ হিসেবে দান করা হয়। সেই ভাবেই চলছিল। পূজারি সাধুর নির্দেশ মতো আস্ত ফল শিবকে নিবেদন করতেন ও পরে তা কেটে প্রসাদ হিসেবে ভক্তদের বিলিয়ে দিতেন। একদিন স্বয়ং শিব পূজারিকে স্বপ্নাদেশ দেন কাশীরাজ নির্মিত এই শিবমন্দিরের আম্র চারাও ভক্তদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হোক—যাতে এই আম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। পূজারিও তাই করেন। কথিত আছে সেই পূজারি নাকি ল্যাংড়া ছিলেন। তাই এই গাছের কলম থেকে বানানো প্রতিটা গাছকে ‘বেনারসী ল্যাংড়া’ বলা হয়।
মোঘল সম্রাট আকবর এক লক্ষ আম গাছ বিহারের দারভাঙা জেলায় রোপণ করিয়েছিলেন। অন্য দিকে জৈন দেবী অম্বিকা মাতাকে দেখা যায় আম্রগাছের নীচে উপবিশনরতা। আর হিন্দু পূজাআর্চায় তো মঙ্গলপ্রতীক স্বরূপ আম্র পল্লব লাগেই। ভারতীয় ঘরানার পোশাকে, বিশেষত কাশ্মীরি শাল, বাংলার বালুচরী। দক্ষিণের কাঞ্চিপুরম সিল্ক শাড়ির সূক্ষ্ম সুতোর কাজের মোটিফেও আম বা আমপাতার ব্যবহার দেখা যায়।
বাঙালিদের মতো অন্য প্রদেশের মানুষও আমের আহ্লাদে আটখানা। সে নীলম, সিন্দুরী, নাদান, বাঙ্গানপল্লি, পইরি, চন্দ্রকরণ, থাম্বুর, বাদামি, মালদা, তোতাপুরী, ল্যাংড়া, আলফানসো, মুলগুয়া, হিমায়থ, দশেরি, প্রিয়ূর, কেসর, মুভান্দন, উনদামাঙ্গা মল্লিকা ইত্যাদি প্রজাতির আমে। যেমন কর্নাটকের মল্লিকা নামের আম সাধারণত বাজারে আসে একটু শেষের দিকেই মে মাসের শেষ অথবা জুন নাগাদ। এর রসালো নির্যাস থেকে আমরস তৈরি হয়। কেরলের ‘মুভান্দন’ আম অনেকটা সময় ধরেই পাওয়া যায়। এই আম আধপাকা অবস্থায় নুন মশলায় জারিত করে খেতে পছন্দ করেন তামাম কেরলবাসী। দক্ষিণেরই আরও এক প্রজাতির আম ‘মুলগুয়া’। কর্নাটকের এই রসালো আমগুলি ভারতের মধ্যে সব চেয়ে ওজনদার। দাড়িপাল্লায় একটা মুলগুয়াই ওজনে তিন, সাড়ে তিন কিলোগ্রাম ওজনের। কেরলের হাইব্রিড জাতীয় উনদামাঙ্গা আমগুলির অম্ল মধুর স্বাদের। অন্ধ্রের ‘হিমায়াথ’ আমটি ‘ইমাম-পসন্দ’ নামেও বেশ পরিচিত। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে অন্ধ্রপ্রদেশে এই মিষ্ট আমটি পাওয়া যায়। কেরালার ‘প্রিয়ুর’ প্রজাতির আম প্রধানতাই একে প্রতিবেশী দক্ষিণের অন্য রাজ্যগুলিতে বিশিষ্টতা দিয়েছে। অন্ধ্র আর কর্নাটকের আরও এক ধরনের আম আছে ‘পোদ্দারসালু’। রসে টইটুম্বর এই আমকে সেখানকার মানুষ আদর করে ‘রসাপুরি’ নামেও ডেকে থাকেন। রসালো এই আমটি কিছুটা আঁশযুক্ত। দক্ষিণের নিলম, নাদন থাম্বুর, চন্দ্রকরণ এই আমগুলিও যথেষ্ট জনপ্রিয়। এর মধ্যে মহার্ঘ হল কর্নাটকের ‘চন্দ্রকরণ’। ঘরেলু আমসত্ত্ব জাতীয় মিষ্টান্ন বানাতে চন্দ্রকরণ আমটি খুব জনপ্রিয়। কেরলের ‘থাম্বুর’ আমের আঁটিটি বেশ বড় হলেও স্থানীয়দের কাছে অতীব মিষ্ট আমটির চাহিদাও প্রচুর। কেরলের ‘নাদন’ আম সেখানকার বিবিধ রান্নায় কাঁচা আমের জিভে জল আনা স্বাদের প্রণালীতে ব্যবহার হয়। কর্নাটক ও কেরলের ‘নিলম’ আম জুন মাসের শেষ দিকেই পাওয়া যায়। তুলনামূলক ভাবে দামেও কিছুটা সস্তা।
এ সব দক্ষিণাত্যের আম-মহাত্ম্য। এ বার উত্তর ভারতের দিকে চোখ ফেরানো যাক। আর সেই পর্বেই উঠে আসে ল্যাংড়া, দশেরি, সিন্দুরি, তোতাপুরি, মালদা, চোষা, পইরি, কেসর, গোলাপখাস, লখনউ সফেদা নামের সমধিক জনপ্রিয় আমের মহিমা। বেনারসী ল্যাংড়ার চাহিদা সর্বজনগ্রাহ্য। পাতিলেবুর মতো আভা এর সর্বাঙ্গে। যেমন গন্ধ, তেমনই অতুলনীয় স্বাদ। দিল্লি ও উত্তরপ্রদেশে ল্যাংড়া আমের ফলনও প্রচুর। মালদা জেলার ল্যাংড়াও ওঠে জৈষ্ঠ মাস নাগাদ। ওই সময় বাংলার জামাইষষ্ঠী পাবর্ণের একটা ঐতিহ্যবাহী উপঢৌকন তত্ত্ব ল্যাংড়া আম। সঙ্গে গ্রীষ্মের উপযোগী অন্যান্য ফল তো থাকেই। দিল্লি উত্তরপ্রদেশে সিঁদুর রাঙা ‘সিন্দুরি’ আম নামটাই এর বিশেষত্ব চিনিয়ে দেয়। গাঢ় হলুদ শাঁস থেকে আমদুধের সরবত দারুণ হয়। দিল্লির ‘মালদা’ নামের আমটিও আঁশহীন রসালো অম্ল-মধুর স্বাদের, এই আম চাটনি বা আচার বানানোর পক্ষেও খুব উপকারি। আমবিলাসীদের কাছে ‘তোতাপুরি’ আমেরও বেশ কদর আছে। অঞ্চলভেদে তোতাপুরি, কিলিমুকু, গিনিমোথি অনেক নাম তার। গ্রীষ্মের আমের বাজার মুখ্যত এই তোতাপুরি আম দিয়েই শুরু হয়। ঈষৎ কাঁচা স্বাদের তোতাপুরির তখন কাটতি খুব। উত্তরপ্রদেশের ‘দশেরি’ ও ‘চৌষা’ আমেরও কদরও রসিক আম-মহলে। উত্তরপ্রদেশের মল্লিহাবাদের কাছে ‘দশেহরি’ গ্রামের দুশো বছরেরও অধিক পুরনো মূল গাছটির অস্তিত্ব এখনও রয়েছে। এই ‘দশেরি’ আমের সবুজ ত্বকের আড়ালে উজ্জ্বল হলুদ মিষ্টি শাঁসের এক আলাদা সুঘ্রাণ। হলুদ রঙা ‘চৌষা’ আমের মুখটা দাঁত দিয়ে কেটে এর ভরপুর নির্যাস ‘চুষে’ খাওয়ারই রীতি। সেই জন্যেই বোধহয় এই আমের ডাক নামটাও অমন। উত্তরপ্রদেশের হরদৌঈ গ্রামের কাছে এই আমের প্রথম উৎপত্তি। নরম রসালো শাঁস আর সুন্দর গন্ধের জন্য এই আমের আলাদা চাহিদা আছে। যেমন উত্তরপ্রদেশেরই আর এক বিখ্যাত আম ‘গোলাপখাস’। লালচে রঙা আমটির গন্ধ একেবারে গোলাপফুলের মতো। আমের বাহারি পদ প্রস্তুতিতে এই আমের জুরি নেই। গোয়া আর গুজরাতের প্রসিদ্ধ ‘পইরি’ আম দিয়ে বোতন বা কৌটায় ‘আমরস’ ব্যবসায় বেশ প্রসিদ্ধ। ঘন কমলা এই আমরস, দুধে, সরবত, পুডিং, কাস্টার্ড, ডেজার্ট বা অন্য খাবারে মিশিয়ে উপাদেয় পদ রান্না হয়।
মহারাষ্ট্রে প্রবাস জীবনের খাতিরে, একানকার রাজকীয় আম, ‘আলফানসো’র দু’চার কথা না বললে এই প্রতিবেদনটাই ফিকে হয়ে যাবে। গোয়ার আবিষ্কারক স্যার অলফনসো-ডি-আলবুকার্ক এর নাম থেকেই আমটির এই ভিনদেশি নামকরণ। স্থানীয় কোঙ্কনি ভাষায় অলফনসো থেকে ‘অপহস’ ও পরে মরাঠি ভাষায় ‘হাপুস’ নাম বিবর্তন। মরাঠিতে কাঁচা আমকে ‘কৈইরী’ বলে। মুম্বই তথা সমগ্র মহারাষ্ট্রে এই হাপুসের চাহিদা খুব। এই আমটি আঁটি থেকে চারা বের হয়। মহারাষ্ট্রের রত্নাগিরি, সিন্ধুদুর্গ, দেবগড়ে এই প্রজাতির আমের ফলন খুব। মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে মে অবধি এই আম দু’মাসের জন্য বাজারে থাকে। পাকার পর মাত্র এক সপ্তাহ পর্যন্ত এই আম সতেজ থাকে। আলফানসো আমের লজেন্স, ক্যান্ডি, স্কোয়াসের চাহিদাও বজায় থাকে সারা বছর। গোদরেজ কোম্পানির ‘জামপিন’, পেপসি কোম্পানি ‘স্লাইস’, কোকাকোলার ‘মাজা’, পার্লে এগ্রো কোম্পানির ‘ফ্রুটি’র লোভনীয় বিজ্ঞাপন এবং স্বাদ তো অতুলনীয়।
মহার্ঘ আলফানসো-র খ্যাতি বিশ্ব বাজারেও। বাক্সবন্দি হয়ে বিদেশে রফতানি হয়, প্রচুর বিদেশি মুদ্রা আসে। এ বছর অবশ্য লক্ষণীয় ভাবে তাতে ভাটা পড়ে গেছে। বিদেশের বাজারে এ বছর ভারতের আলফানসো বাতিল হয়েছে। ইউরোপের ‘ডিপার্টমেন্ট অফ এনভায়ারেনমেন্ট অ্যান্ড রলার অ্যাফেয়ার্স’ আলফানসো আমের দূষণ নিয়ে প্রশ্ন তুলে আমদানি বন্ধ করেছে। ইউরোপে যেখানে প্রতিবছর গড়ে ৬.৩ মিলিয়ন পাউন্ড আলফানসো আম ভারত থেকে আমদানি হত সেখানে এই বাতিল সংক্রান্ত বিরোধিতা খুবই ধাক্কা খেয়েছে ভারতের বাণিজ্য ব্যবসায়। মুম্বইয়ে আলফানসোর দামও তাই নেমে গেছে এ বার। ‘ইউরোপিয়ন ইউনিয়ন’ প্যাকেজিং-এর গলদ ও আমে পরজীবি কীটানু আক্রান্ত সংক্রান্ত বিষয় পরীক্ষা মূলক ভাবে প্রমাণও করেছে। ও দিকে ইউ কে ম্যাঙ্গো ইমপোর্টার প্রধান মল্লিকা ভাণ্ডারী বিবিসিকে দেওয়া বিবৃত্তিতে বলেছেন, ভারতের প্রোডাক্ট শূন্য শতাংশ দূষণমুক্ত।
এ সব ব্যবসায়িক উতোরচাপান চলুক। আমরা গ্রীষ্মের এই দাহে আম বিলাসিতা করে নিই খানিক। রবিঠাকুরের উদ্ধৃতি অনুসরণ করা যাক আবারও—
“আমসত্ব দুধে ফেলি
তাহাতে কদলি দলি’
সন্দেশ মাখিয়া তাতে...
হাপুস হুপুস শব্দ, চারিদিক নিঃশব্দ,
পিপীলিকা কাঁদিয়া যায় পাতে...”
অতএব, হে বাঙালি, আসুন এই প্রখর গ্রীষ্মে প্রভূত পরিমাণে আম খাই। আর আম্রবিলাসিতায় কাটিয়ে দিই সমগ্র গ্রীষ্মযাপন।