ভোটের মুখে নরেন্দ্র মোদীর ভজনা থেকে দূরে থাকার পরামর্শ। তা-ও স্বয়ং সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতের মুখে!
সঙ্ঘ নেতৃত্বই বিজেপি নেতাদের একাংশের ঘোর আপত্তি উপেক্ষা করে মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থী করেছেন। এখনও বিজেপি-কে ক্ষমতায় আনার জন্য মোদীর পথ সুগম করতে লাগাতার চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁরা। অথচ সেই সঙ্ঘ-প্রধানই এখন আরএসএস-এর কর্মী-নেতাদের পরামর্শ দিচ্ছেন মোদী-ভজনা থেকে দূরে থাকতে। সঙ্ঘের নিজস্ব মর্যাদা লঙ্ঘন না করতে। বেঙ্গালুরুতে সঙ্ঘের প্রতিনিধি সভায় ভাগবত কাল বলেছেন, “আমাদের কাজ নয় ‘নমো-নমো’ (নরেন্দ্র মোদীর সংক্ষিপ্ত নাম) করা। আমাদের নিজেদের সীমা রয়েছে। সেই সীমা অতিক্রম করা উচিত নয়।”
স্বাভাবিক ভাবেই সরসঙ্ঘচালক যখন এ ধরনের মন্তব্য করেন, তখন সেটিকে গোটা আরএসএস শুধু নয়, বিজেপি শিবিরও গুরুত্ব সহকারে দেখে। ভাগবত কী বলতে চাইলেন, তা নিয়েও চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়। ভোটের মুখে ভাগবতের এই মন্তব্য নিয়ে বিজেপি-র অন্দরে তৈরি হওয়া অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে তুলেছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। কংগ্রেসের নেতা দিগ্বিজয় সিংহ এ নিয়ে বলেছেন, “ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদী সবার উপরে, এই ভাবমূর্তি তিনি নিজেই তৈরি করেছেন। এখন শুধু বিজেপি-ই নয়, আরএসএস-ও তার ঠেলা টের পাচ্ছে। এখন তো সঙ্ঘ-বিজেপি ছোট। মোদী বড় হয়ে গিয়েছে। টাকার জোরে সকলকে কিনে নিতে চাইছে।”
তা হলে কি মোদীর থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে চাইছেন ভাগবত?
সত্যিই কি সঙ্ঘ বা দলের তুলনায় ব্যক্তি মোদীর উচ্চতা বাড়তে দেখে ভাগবত এমন বার্তা দিলেন? সঙ্ঘকে সরিয়ে আনতে চাইলেন বিজেপি-র ব্যক্তি-কেন্দ্রিক প্রচার থেকে।
এই সব প্রশ্ন উঠছে দেখেই আরএসএস-এর মুখপাত্র তড়িঘড়ি বিষয়টিকে লঘু করে দেখানোর চেষ্টা করেন। সঙ্ঘ নেতা রাম মাধব বলেন, “সরসঙ্ঘচালক কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে মন্তব্য করেননি। তিনি বুঝিয়েছেন, আরএসএস কোনও রাজনৈতিক দল নয়। আরএসএস তার লক্ষ্য নিয়ে এগোবে। বিজেপি তার নিজের লক্ষ্যে।” সঙ্ঘের আর এক নেতা বলেন, “ভাগবত এ-ও বলেছেন যে, এই সময় কে ক্ষমতায় আসবেন, তার থেকেও বড় কথা কাদের আসা উচিত নয়। সঙ্ঘ যাতে নিছক রাজনৈতিক বিষয়ে সীমাবদ্ধ না থেকে গোটা সমাজকে সংগঠিত করার কাজেই মনোনিবেশ করে, সেই পরামর্শই দিয়েছেন ভাগবত। বলেছেন, গণতন্ত্র ও দেশের স্বার্থে যাতে সকলে ভোট দেন, তা সুনিশ্চিত করতে ভোটারদের শিক্ষিত করার কাজও করবে সঙ্ঘ।”
সঙ্ঘের সাফাইয়ের পর বিজেপি-র রবিশঙ্কর প্রসাদও বিতর্ক এড়াতে বলেন, “আরএসএস-এর ওই বক্তব্যের পর আমাদের কিছু বলার নেই। দেশ পরিবর্তন চায়। আমাদের দলে ব্যক্তিবাদ, পরিবারবাদ কখনওই মাথাচাড়া দেয় না। সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
কিন্তু বিতর্ক এতে থামছে না। সঙ্ঘের শীর্ষ সূত্র বলছে, মোদীকে পূর্ণ সমর্থন জোগাতে গিয়ে সঙ্ঘও সম্প্রতি কোনও না কোনও ভাবে বিরোধীদের নিশানায় চলে আসছে। রাহুল গাঁধী নিরন্তর সঙ্ঘকে আক্রমণ করছেন। এই পরিস্থিতিতে সঙ্ঘের নেতা-কর্মীদের সতর্ক করাও সরসঙ্ঘচালকের কাজ। যে ভাবে মোদী ক্ষমতায় আসছে ধরে নিয়ে আরএসএসের একাংশের মধ্যে ক্ষমতার লোভ কাজ করছে, তাতেও লাগাম টেনে ধরা উচিত। কিন্তু ভাগবতের মন্তব্যের নেপথ্যে আরও একটি বড় কারণ রয়েছে।
মোদী যে ভাবে ভোটের আগে পিছিয়ে পড়া শ্রেণিদের কাছে টানতে তৎপরতা দেখাচ্ছেন, সঙ্ঘের ব্রাহ্মণরা সেটাকে ভাল চোখে দেখছেন না। বিশেষ করে সারস্বত ব্রাহ্মণরা। বরাবরই সঙ্ঘে, এমনকী বিজেপি-তেও উচ্চবর্ণরা প্রাধান্য পেয়ে এসেছেন। মোদী যেমন নিজের ওবিসি তাস খেলছেন, তেমনই প্রাধান্য দিচ্ছেন রামবিলাস পাসোয়ান, উদিত রাজ, রামদাস আটাওয়ালে, উপেন্দ্র কুশওয়াহার মতো পিছিয়ে পড়া শ্রেণির নেতাদের। এতেই দল ও সঙ্ঘের উচ্চবর্ণের নেতা-সদস্যদের গোঁসার কারণ হয়ে উঠেছেন তিনি। তাঁদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে মোদী না নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে সঙ্ঘের গুরুত্বই খাটো করে দেন!
এই পরিস্থিতিতে সরসঙ্ঘচালকের তরফেও একটি কড়া বার্তা দেওয়া প্রয়োজন ছিল বলে মনে করছেন সঙ্ঘ-নেতাদের একাংশ। তিনি যদি সত্যিই বোঝাতে চাইতেন, আরএসএস কর্মীদের ব্যক্তিপূজা করার প্রয়োজন নেই, তা হলে সেই ভাষাতেই তা বোঝাতে পারতেন। ‘নমো-নমো’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করার তাঁর প্রয়োজন ছিল না। এই শব্দ ব্যবহার করেই তিনি মোদীকেও বার্তা দিলেন যে, সঙ্ঘ তার নিজের পথেই থাকবে। বিজেপি-র নিত্যদিনের কাজে সঙ্ঘ নাক গলাতে চায় না। ভোটে বিজেপি-র ক্ষমতায় আসা দরকার। তাই বলে মোদীকে অহেতুক গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই। মোদী ক্ষমতায় এলেও রাশ যে সঙ্ঘের হাতেই থাকবে, সেটাই স্পষ্ট ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন ভাগবত।