কাছাকাছি। প্রেম দিবসে গুয়াহাটির চিড়িয়াখানায়। রবিবার উজ্জ্বল দেবের তোলা ছবি।
একেই বলে হাতে না মেরে ভাতে মারা। প্রেম দিবসের যুদ্ধে নেমে দিনের শুরুতেই প্রেমিকদের প্রধান হাতিয়ার লুঠ করল নীতি-পুলিশের দল। শিলচরের বাজার থেকে সব গোলাপ উঠিয়ে নিয়ে গেল অজ্ঞাতপরিচয় হানাদারেরা! অন্য দিকে, করিমগঞ্জের রেস্তোঁরাগুলিতে বিভিন্ন বিধিনিষেধের ফতোয়া জারি করে আসে পুলিশ।
অবশ্য নির্দেশ ও নজরদারি লাল চোখ প্রেমের প্রকাশ থামাতে পারেনি। শনিবারের সরস্বতী পুজো আর রবিবারের ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’— পড়ে পাওয়া প্রেমের প্যাকেজ যে ভাবে পেরেছে উসুল করে নিয়েছে শাড়ি আর পাঞ্জাবীর যুগলবন্দী। চন্দনের বন তো মেলেনি। তবু, ভ্রু-পল্লবের ডাকে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন উদ্যান, রেস্তোঁরা, নদীর পার বা রাজপথেই দেখা হয়েছে দু’জনের। শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে হোয়্যট্স অ্যাপে হাতবদল হয়েছে গোলাপ। সে ফুলে গন্ধ না থাক, বাসন্তী হাওয়া ভুলিয়ে দিয়েছে একটু-আধটু না পাওয়ার দুঃখ।
বজরং দল এ’বছর রাঁচিতে প্রেম দিবসের ‘নোংরামি’ রুখতে অভিনব কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ঘনিষ্ঠ হতে গিয়ে ধরা পড়লে সোজা বিয়ের মণ্ডপে হাজির করা হবে যুগলকে। অভিভাবকদের ডেকে পাঠিয়ে বিয়ে দিয়ে তবে মুক্তি। কিন্তু, বরাকে বজরং দলের তেমন সাধ বা সাধ্য নেই। বজরঙ্গ দলের দক্ষিণ-পূর্ব জোনাল ইউনিটের কো-অর্ডিনেটর মান্না মুখোপাধ্যায় জানান, রাস্তাঘাটে কোনও যুগলকে ঘনিষ্ঠ বা অস্বস্তিকর অবস্থায় দেখলে তাঁরা নিজেরা হস্তক্ষেপ না করে পুলিশের সাহায্য নেবেন। তিনি বলেন, ‘‘প্রেম আর অশ্লীলতা এক জিনিস নয়। কিন্তু ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’-র নামে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা অশালীন আচরণ করে। সমাজ-সংস্কৃতির ধার ধারে না। এই জিনিস মেনে নেওয়া যায় না। তেমন কিছু চোখে পড়লেই আমরা পুলিশ ও প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করব। পশ্চিমী সংস্কৃতি আমদানির সব ধরনের বিরোধিতা চলতে থাকবে।’’
বজরঙ্গ দলের সাধারণ সম্পাদক গৌতম চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আমরা শুধু ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ নয়, ‘রোজ ডে’, ‘কিস ডে’-সহ সব পশ্চিমী দিবসের বিরোধী। তাই সারা বছর আমাদের নজরদারি চলতে থাকবে।’’
সম্ভবত পুলিশের উপরে পুরোপুরি ভরসা রাখতে পারেনি নীতি-পুলিশরা। তাই, সকাল হতেই বিভিন্ন বাজারে হানা দিয়ে যেখানে যত গোলাপ পেয়েছে, লুঠ করেছে তারা। সেন্ট্রাল রোডের ফুল ব্যবসায়ী দীপঙ্কর ঘোষ বলেন, ‘‘প্রেম দিবসে বিক্রির জন্য প্রচুর গোলাপ এনেছিলাম এ বার। সকাল থেকে বিক্রি ভালই চলছিল। আচমকা মোটরসাইকেল নিয়ে একদল যুবক আসে। নির্দেশ দেয়, আজকের দিনে লাল গোলাপ বিক্রি একদম নয়। চোখরাঙানির ভয়ে কথা বাড়াইনি। সব গোলাপ ঢেকে দিই। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ফের তারা চড়াও হয় দোকানে। সমস্ত গোলাপ তুলে নিয়ে যায়। তছনছ করে অন্যান্য সামগ্রী। পুলিশের সাহায্য চেয়েও মেলেনি।’’ বাজারের অন্যান্য দোকানেও একই ঘটনা ঘটে।
গৌতমবাবু অবশ্য দাবি করেন, ফুলের দোকানে তাঁদের সদস্যরা হামলা চালাননি। তাঁদের নাম করে অন্য কোনও দল এই কাণ্ড করেছে।
বজরং দলের পক্ষ থেকে আজ ক্ষুদিরাম মূর্তির পাদদেশে ভগৎ সিং, রাজগুরু, শুকদেবদের স্মৃতিতে শহীদ দিবস পালন করা হয়। বজরং দলের পক্ষ থেকে শিলচর শহরে তিন শহীদের প্রতিমূর্তি স্থাপনের দাবি জানানো হয়েছে। ১৪ ফেব্রুয়ারিকে দেশপ্রেমিক দিবস হিসেবে ঘোষণার দাবি ওঠে সেখানে। এ হেন প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলেও শিলচরে সরস্বতী পুজোর ভাসানের হাত ধরেই প্রেম দিবসের উদ্যাপনও চলল ঠারেঠোরে। কিশলয় মন কাঙ্খিত দুষ্টুমির আবডাল নিজের মতো করেই খুঁজে নিয়েছে।
এ দিকে, করিমগঞ্জ শহরের প্রেমিক-প্রেমিকাদের বড় অভিযোগ, এই শহরে না আছে কোনও উদ্যান, না রয়েছে সরোবর। তাই, রাজপথে হেঁটে বা রেস্তোঁরার টেবিলেই সেরে নিতে হয় প্রেমালাপ। এ বছরের প্রেম দিবসে সে’দিকেও পুলিশের কড়া খবরদারি! গত কালই টাউন দারোগা মিন্টু শীল এসে সব রেস্তোঁরায় ফতোয়া দিয়ে গিয়েছেন— চেয়ার কোনওমতেই দেওয়ালের দিকে ঘোরানো চলবে না। কোনের দিকে বসা চলবে না। পর্দা দেওয়া আসন নৈব নৈব চ! কোনও হোটেল-রেস্তোঁরায় কাউকে অসংলগ্ন অবস্থায় দেখা গেলেই শাস্তি জুটবে হোটেল মালিকের।
করিমগঞ্জে কয়েকটি রেস্তোঁরায় ঘণ্টা হিসেবে চেয়ার ভাড়া দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ‘অনৈতিক’ কাজ চলার অভিযোগও উঠেছে কিছু হোটেল-রেস্তোঁরার বিরুদ্ধে। গত বছর প্রেম দিবসে করিমগঞ্জে বজরঙ্গ দল ছেলেমেয়েদের রেস্তোঁরা থেকে টেনে বের করে দিয়েছিল। এ নিয়ে শহরজুড়ে তীব্র উত্তেজনা ছড়ায়। তাই, এ বার পুলিশই আগে থেকে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। অবশ্য দিনভর শালীনতা বজায় রেখেই আজকের প্রেমপর্ব সারল করিমগঞ্জের ছেলেমেয়েরা। বজরঙ্গ দল বা পুলিশকে কোথাও হানা দিতে হয়নি। গণ্ডি টানা প্রেমপর্ব আলতো ছোঁয়া আর পেট পুজোতেই সারতে হয়েছে। অবশ্য সে দিক থেকে গুয়াহাটির প্রেমদিবস ছিল অনেক খোলামেলা, উচ্ছ্বল। গতকাল থেকে শুরু হওয়া স্কুল-কলেজ-রাজপথের ফ্যাশন শো আজ ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছায়। রবিবারে প্রেম দিবস পড়ায় বিভিন্ন ডিস্কো, হোটেল, বার, রিসর্টগুলি আগেভাগেই নামকরা ডি-জে, নজরকাড়া ‘থিম’ আর মনকাড়া মেনুর বিজ্ঞাপনে লোক টানছিল। আয়োজন ছিল ফ্যাশন শো, ‘ক্রুজ সানডাউনার পার্টি’র। শাড়ি থেকে স্বল্পবাস, শর্টস থেকে স্যুট— ইচ্ছেমতো বাহারে, কলাক্ষেত্র, নেহরু পার্ক, চিড়িয়াখানা, শ্রদ্ধাঞ্জলি পার্ক, জু-রোড, জি-এস রোড, গুয়াহাটি ক্লাব, ফ্যান্সিবাজার আর ব্রহ্মপুত্রের পার ধাঁধিয়ে দিল প্রেম দিবসের কুশীলবরা। সুয্যি ডুবতেই ঠোঁটে-ঠোঁট রেখে গড়ে উঠল ব্যারিকেড। সে বেড়া ভাঙে— নীতি পুলিশের সাধ্য কী?