কুণাল সিংহ ও শত্রুঘ্ন সিন্হা
লড়াইটা শুধু বিজেপি বনাম কংগ্রেস-আরজেডির নয়। লড়াইটা ‘বিহারিবাবু’ বনাম ‘বাংলার জামাইবাবু’-রও। কারও কারও কাছে এটা আবার মুম্বই বনাম ভোজপুর।
কেন্দ্রের নাম পটনা সাহিব। যেখানে এক দিকে বর্তমান সাংসদ তথা বিজেপি প্রার্থী শত্রুঘ্ন সিন্হা। অন্য দিকে কংগ্রেস প্রার্থী কুণাল সিংহ। ‘বিহারীবাবু’ শত্রুঘ্ন বলিউডের প্রিয় ‘শত্রু’। আর কুণাল এক দিকে যেমন ভোজপুরি ফিল্মের ‘অমিতাভ বচ্চন’, অন্য দিকে তিনি আবার বাঙলার ‘জামাই’ও। তাঁর স্ত্রী টলিউডের একদা ডাকসাইটে নায়িকা আরতি ভট্টাচার্য।
কিন্তু লড়াই কোথায়? দুই প্রতিপক্ষই তো একে অন্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ! যে ভোটযুদ্ধে নেমে প্রার্থীরা একে অন্যকে নানা ভাবে, এমনকী ব্যক্তিগত আক্রমণও করে চলেছেন, সেখানে এই দু’জন একেবারেই অন্য রকম। একে অন্যের প্রশংসাই করছেন! এ দেশের ভোটবাজারে যা বিরল! শত্রুঘ্নর কথায়, “পটনা সাহিব দেশের কাছে মডেল হতেই পারে। এখানে আমরা প্রচার করছি দেশের কথা নিয়ে, ইস্যুভিত্তিক। কোথাও কোনও ব্যক্তিগত কুৎসা নেই। এটা শুধু আমি না, সকলেই তাই করছেন। আর কুণাল তো আমার বন্ধু।”
প্রায় একই কথা কুণালের মুখেও। শত্রুঘ্নের কথা উঠতেই দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন, “ওঁকে আমি প্রণাম করি। শত্রুজি খুব ভাল মানুষ। ওঁকে নিয়ে আমার ব্যক্তিগত কোনও কথাই নেই। আমরা খুব ভাল বন্ধুও। আসলে লড়াইটা নীতির।”
পারস্পরিক এই সম্মান দেখানোর আড়ালে যেটা চলছে, তা হল একটা টানটান, তীব্র লড়াই। যদিও কংগ্রেস শিবিরে যখন সাজসাজ রব, ‘শত্রু শিবির’ তখন ‘কুল’!
শত্রুঘ্নের শিবির। পটনার একটি পাঁচতারা হোটেলে ঘাঁটি গেড়েছেন শত্রুঘ্ন। সকাল ন’টায় সেখানে পৌঁছতেই রিসেপশনে বসা মহিলা অবাক! ‘‘এত সকালে এসেছেন! স্যার তো এখনও ওঠেননি। ভিজিটারও নিচ্ছেন না। ফোন করতেও বারণ করেছেন।” ঘণ্টাখানেক পরে শত্রুঘ্ন-র সহকারী রাজীব কুমার নিজেই ফোন করলেন এবং জানালেন, সাহেবের সঙ্গে কথা বলে সাক্ষাতের সময়টা জানিয়ে দেবেন। কিছুক্ষণ পরে ফের ফোন, “দুপুর ১২টা নাগাদ চলে আসুন”।
হোটেলের বিশাল ঘরের টেবিলের এক প্রান্তে বিহারিবাবু। পরণে কালো হালকা কোট। গলায় উত্তরীয়। শুরুতেই বললেন, “আপনাদের পত্রিকাকে আমি সম্মান করি। বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি-জীবনের ক্ষেত্রে আপনাদের বিরাট ভূমিকা।” এর পরে সাক্ষাৎকার নয়, শুধু গল্প। কলকাতায় সত্যজিৎ রায়, উত্তম কুমার, মৃণাল সেন, জিনত আমনের সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে কী বলে বক্তৃতা শুরু করেছিলেন, সেটা আজও স্পষ্ট মনে আছে! বাংলায় বলা লাইনগুলো ফের আউড়ে গেলেন। এখনও কি বাংলা বলতে পারেন? হেসে বললেন, “অনেক দিন অভ্যাস না থাকলে যা হয়।” কথার মধ্যেই সঙ্গীদের এক জনকে ডেকে বললেন, ‘‘আরে আমাদের একটু বেলের সরবৎ দাও। গলা তো দু’জনেরই শুকিয়ে গিয়েছে!” কথার শেষে ট্রেডমার্ক ‘খামোশ’ বলেই হেসে উঠলেন।
উঠল ভোটপ্রসঙ্গ। প্রচারের সময় স্ত্রী পুনম কেমন খাটাখাটি করছেন, নিজেই সে প্রসঙ্গ তুলে বললেন, “উনিই তো আমার সব কাজ করছেন। মহিলাদের ভোট টানতে পুনমের এ বারের ভূমিকা আমি ভুলব না।” আর মেয়ে সোনাক্ষী? “ওর হাতে তো এখন অনেক কাজ। ব্যস্ত।” কিন্তু নির্বাচনের মুখে আপনি নিশ্চিন্তে ঠান্ডা ঘরে বসে আছেন? এ বারের নির্বাচনে নীতীশ কুমার এনডিএ-তে নেই। ভোট ভাগাভাগির সম্ভাবনা......! মুখের কথা কেড়ে নিয়ে তাঁর জবাব, “আরে ভাই আমার উল্টো দিকেও তো ভোট ভাগ হবে। আমাকে দেখে কী মনে হচ্ছে? কোনও টেনশন আছে? নেই।” নিশ্চিন্ত গলায় তাঁর জবাব, “মানুষকে আমি বেশি বিরক্ত করি না। রাত ৮টার মধ্যে ‘প্যাক আপ’ করে দিই।”
কুণাল-শিবির। সকাল ন’টা। পটনার কাজিপুরে কুণাল সিংহের পৈতৃক বাড়িতে তখন হুলুস্থূল চলছে। কুনাল বকতিয়ারপুরের জনসভায় যাচ্ছেন। ঘরের বিশাল বৈঠকখানার দেওয়ালে টাঙানো ফ্রেমবন্দি বুদ্ধদেব সিংহ। কুণালের বাবা। রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী। ১৯৫৭ থেকে ১৯৯০, ৩৩ বছর টানা বিধায়ক ছিলেন। পাশে সুপারস্টার কুণালের অসংখ্য ছবি। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাত থেকে পুরস্কার নেওয়ার ছবিও রয়েছে সেখানে।
শুরুতেই ঝটকা। ঝরঝরে বাংলায় কথা শুরু করলেন কুণাল। এত ভাল বাংলা বলেন? ততক্ষণে আসরে হাজির কুণাল-পত্নী আরতি সিংহ, থুড়ি ভট্টাচার্য। উত্তম কুমারের হাফ ডজন হিট ছবির নায়িকা। সে দিকে তাকিয়ে কুণাল বললেন, “না শিখে উপায় আছে?” আরতি বললেন, “ওর ভাষা আমি যেমন রপ্ত করেছি, তেমনই আমার ভাষাও ওকে শিখিয়েছি।” শুধু কুণালকে নয়, ছেলে আকাশও গড়গড়িয়ে বাংলা বলতে পারেন। দু’জনের আলাপ কী করে? আরতিই বললেন, “১৯৮৩ সালে একটি ছবিতে কাজ করতে এসে আলাপ। ‘কাল হামারা হ্যায়’ ছবিটি ছিল পুরোপুরি বিহারের উপরে। শুটিংও বিহারেই হয়। তার পরেই প্রেম এবং বিয়ে।”
ভোটপ্রসঙ্গ উঠতেই কুণাল বদলে গেলেন। বললেন, “আমি কিন্তু প্রথমে রাজনীতির লোক, পরে অভিনেতা। রাজনীতির আবহেই বড় হয়েছি। ফলে আমার কাছে এই ক্ষেত্রটি নতুন না।” তাঁর ব্যাখ্যা, “আমি প্রদেশ কংগ্রেসের শিল্প-সংস্কৃতি সেলের সভাপতি। ফলে আমি রাজনীতিতেই ছিলাম। বলতে পারেন নির্বাচনে প্রথম।” স্ত্রী-র সাহায্য মিলছে? সহাস্য কুণালের জবাব, “ও-ই তো আমার ব্যাক অফিস!” লোকচক্ষুর আড়ালে বাড়িতে থেকেই সব দিক সামলে যাচ্ছেন আরতি।
জয় নিয়ে প্রত্যয়ী কুণালের কথায়, “মানুষ আমাকে জানেন। পটনায় আমাকে ওঁরা সব সময় পাবেন। রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য হওয়ায় মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার বিষয়ে আমি সব সময় সজাগ।”