সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন মোদী। ছবি: রয়টার্স
উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, বিজয়ীকে উদারতা দেখাতে হয়।
কিন্তু লোকসভার যুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তখনই উদার হয়ে উঠলেন নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদী!
বিজেপির প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী বললেন, ক্ষমতায় এলে দুর্নীতির অভিযোগে সনিয়া গাঁধীর জামাইকে জেলে পোরার বাসনা তাঁর নেই। প্রতিপক্ষ শিবিরের নেতাদের বিরুদ্ধে সিবিআই লেলিয়ে দিতেও চান না। মোদীর দাবি, প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন না তিনি। আইন মোতাবেক যা হওয়ার তাই হবে।
আগামিকাল ১২ রাজ্যের ১২১টি আসনে ভোটগ্রহণের আগে কেন এই উদারতা দেখাতে হচ্ছে মোদীকে?
বিজেপি নেতৃত্বের মতে, এ বারের ভোটে এই উদারতার অভাবের অভিযোগই বারবার ধেয়ে এসেছে মোদীর দিকে। তাঁর বিরুদ্ধে এটাই সবথেকে বড় প্রচার। সনিয়া-রাহুল থেকে শুরু করে বিজেপি-বিরোধী সব নেতাই জনমানসে এই ধারণা তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন যে, মোদী ক্ষমতায় এলে স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। হিটলার যে ভাবে জার্মানিতে ভোটে জেতার পরে জাতীয়তাবাদের নামে ইহুদি, কমিউনিস্ট, জিপসিদের হত্যা করেছিলেন, মোদীও সে ভাবে তাঁর অপছন্দের লোকেদের খতম করবেন। বিজেপির মতে, গুজরাত দাঙ্গার প্রসঙ্গ তুলে আসলে সংখ্যালঘু-মন বিষিয়ে দিতে চাইছে বিরোধীরা। যাতে ভোটের মেরুকরণ হয়। মোদী যাতে গোটা দেশের নেতা হয়ে উঠতে না পারেন।
আর সেই সম্ভাবনা ঠেকাতেই সচেষ্ট মোদী। কাল উত্তরপ্রদেশের ১১টি আসনে ভোট। যেখানে ভোটদাতাদের একটা বড় অংশ সংখ্যালঘু। ঠিক তার আগের দিন এক সাক্ষাৎকারে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে মোদী বলেছেন, “আমার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ যদি এক কণাও সত্যি হয়, তা হলে আমাকে খোলা রাস্তায় ফাঁসি দেওয়া উচিত। যাতে আগামি একশো বছরে কেউ এমন অপরাধ করার সাহস না পায়।” বিরোধীদের অভিযোগ, গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে এক বারের জন্যও ক্ষমা চাননি মোদী। মোদীর জবাব, “দুঃখপ্রকাশ করলেই কাউকে ক্ষমা করে দেওয়া যায় নাকি! আমি যদি অপরাধী হই, তা হলে আমাকে ক্ষমা করা হবে কেন?” নিজের তরফে উদারতার বার্তা দেওয়ার পাশাপাশি মোদী আজ বিরোধীদের দিকেই প্রতিহিংসার রাজনীতির পাল্টা অভিযোগ ছুড়ে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, “(গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে) ২০০২ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত দেশের সব শীর্ষ সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাব দিয়েছি। কিন্তু দেখলাম, সত্যিটা বোঝার ইচ্ছাই নেই।” মোদীর প্রতি সংখ্যালঘুদের আস্থা ফেরানোর চেষ্টা চালাচ্ছে তাঁর দলও। বিজেপি নেতা রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেন, “গুজরাতের সংখ্যালঘুরা যেমন তাঁর উন্নয়নের শরিক হয়েছেন, গোটা দেশের সংখ্যালঘুরাও সেই সুফল পাবেন।”
এ দেশে বিরোধীদের কণ্ঠরোধের সবচেয়ে বড় উদাহরণ ১৯৭৫-এর জরুরি অবস্থা। কিন্তু যাঁর হাত ধরে সেই অন্ধকারের দিন এসেছিল, সেই ইন্দিরা গাঁধীও এক বার প্রণব মুখোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, ভোটের আগে প্রচারের স্বার্থে যতই আক্রমণ হোক না কেন, ভোটের পর ক্ষমতায় এলে কিন্তু রাষ্ট্রধর্মই পালন করতে হয়। জরুরি অবস্থার শেষে জনতা পার্টির সরকারের আমলে মোরারজি দেশাই শাহ কমিশন গড়ে ইন্দিরাকে বেগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৮০-তে ফের ক্ষমতা দখল করে আর প্রতিশোধের রাজনীতির পথে হাঁটেননি ইন্দিরা।
রাজীব গাঁধীর বিরুদ্ধে বফর্স কেলেঙ্কারির অভিযোগ তুলে ক্ষমতায় এসেছিলেন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পরে সে প্রসঙ্গ নিয়ে বিশেষ নাড়াচাড়া করেননি তিনি। বফর্স নিয়ে মাথা ঘামাননি অটলবিহারী বাজপেয়ীও। ২০০৪-এ ক্ষমতায় ফিরে কংগ্রেসও বাজপেয়ীর জামাই রঞ্জন ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে পদক্ষেপ করেনি।
অনেকেরই মতে, প্রতিশোধের রাজনীতি ভারতীয় ঐতিহ্যের পরিপন্থী। তার উপরে এখন যা রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাতে সেই সুযোগ আরও কম। কিন্তু বিরোধীদের লাগাতার প্রচার ভোটারদের মনে মোদী সম্পর্কে আশঙ্কার জন্ম দিতে পারে বলে বিজেপি নেতাদের ধারণা। সেই সম্ভাবনা ঠেকাতেই সরব মোদী।