অভিনন্দন। শপথগ্রহণের পরে তিন প্রতিবেশী রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী। (বাঁ দিক থেকে) পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী নবীন রামগুলাম এবং শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপক্ষে। সোমবার পিটিআইয়ের ছবি।
নয়াদিল্লিতে পা রেখেই লাহৌর বাসযাত্রার স্মৃতিকে আজ উস্কে দিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শপথগ্রহণে আসবেন কি না তা নিয়েই সন্দেহ ছিল। কিন্তু ভারতে এসেই শরিফ জানিয়েছেন, ১৯৯৯ সালে তিনি এবং অটলবিহারী বাজপেয়ী যেখানে শেষ করেছিলেন, সেই সূত্রটি থেকেই আজ আবার সম্পর্ক শুরু করতে চান। তবে মোদী তাড়াহুড়ো করে পা এগোতে চান না বলেই কূটনৈতিক সূত্রে খবর।
১৯৯৯ সালটি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে একটি মাইলফলক হয়ে রয়েছে। ওই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে বাজপেয়ী-নওয়াজের যৌথ কূটনৈতিক প্রয়াসে ঘটেছিল লাহৌর বাসযাত্রা। তার পরেই আসে কার্গিল যুদ্ধ। ফের ধাক্কা খায় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। কূটনীতিকরা জানিয়েছেন, সুখস্মৃতিকে বিপণন করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দিশা খুঁজতে চাইছেন পাক প্রধানমন্ত্রী। তবে বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের খবর, মোদী যথেষ্ট সতর্ক হয়ে পা ফেলতে চান। শপথগ্রহণে সার্ক গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির রাষ্ট্রপ্রধানদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ইতিমধ্যেই নজিরবিহীন পদক্ষেপ করেছেন। ইতিবাচক বার্তা দিয়েছেন প্রতিবেশী বলয়ে। কিন্তু, আগামী কালই শরিফের সঙ্গে আলোচনায় বসে তাড়াহুড়ো করে নীল নকসা তৈরি করতে চান না তিনি। ভবিষ্যতের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরিই তাঁর লক্ষ্য বলে মনে করা হচ্ছে।
হায়দরাবাদ হাউসে মোদীর সঙ্গে নওয়াজ শরিফের যে বৈঠকটি হবে তার জন্য ধার্য করা হয়েছে তিরিশ মিনিট। নওয়াজ ছাড়াও অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গেও এই সময়সীমার মধ্যেই বৈঠক করবেন মোদী। স্বাভাবিক ভাবেই এই স্বল্প সময়ে ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে সমস্ত দিক নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয়। ভারতের লক্ষ্যও সেটা নয়। তবে মুম্বই সন্ত্রাসের পরে থমকে থাকা সামগ্রিক আলোচনার প্রক্রিয়া পাকিস্তান ফের শুরু করতে চাইবে বলে মনে করা হচ্ছে। শরিফের সঙ্গে দেখা করার কথা কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী হুরিয়ত নেতাদেরও। এই সফরকে পাকিস্তানের কতটা কাজে লাগানো যায় তা দেখবেন বলে কট্টরপন্থী হুরিয়ত নেতাদের কথা দিয়েছেন শরিফ।
তবে এই সফরের মূল সুরটা যে সম্প্রীতির এবং দীর্ঘদিনের বরফ গলানোর জন্য অভিনব চেষ্টা মোদী করেছেনসে কথা কিন্তু গোড়া থেকেই মাথায় রাখছেন নওয়াজ শরিফ। স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে নয়াদিল্লিগামী বিশেষ বিমানে বসার আগেই তাই ‘শান্তি’-র বার্তা শুনিয়েছেন তিনি। সম্প্রীতির বার্তা দিতে গত কালই ১৫১ জন ভারতীয় ধীবরকে মুক্তি দিয়েছে পাকিস্তান। গত কাল রাতে লাহৌরে ভাই শাহবাজ শরিফ ও অন্য শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে ভারত সফর নিয়ে বৈঠক করেন শরিফ। পাক সংবাদমাধ্যমের দাবি, কাশ্মীর, স্যার ক্রিক-সহ সব সমস্যারই সমাধান করা যাবে বলে ওই বৈঠকে আশা প্রকাশ করেছেন শরিফ। হায়দরাবাদ হাউসের বৈঠকে পাক প্রধানমন্ত্রী কাশ্মীর প্রসঙ্গ তুলবেন বলেই ধারণা ভারতীয় কূটনীতিকদের।
আজ সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি ভবনে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে নওয়াজ আগাগোড়া বসেছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের পাশে। মাঝেমধ্যেই দেখা গিয়েছে তাঁদের আলাপচারিতায় ডুবে যেতে। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মনমোহনেরও খুব ইচ্ছা ছিল এক বার পাকিস্তান সফরের। কিন্তু দল তাঁকে সে সুযোগ দেয়নি। দু’জনের মধ্যে এক বারই পার্শ্ববৈঠক হয় গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশনে।
মনমোহন যা করতে পারেননি তা-ই করে দেখিয়েছেন মোদী। পাক প্রধানমন্ত্রী মনে করেন দু’টি দল অর্থাৎ ভারতের বিজেপি এবং পাকিস্তানের মুসলিম লিগবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসায় এ বার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে যা আগে সম্ভব হয়নি।
তবে কূটনীতিকরা জানাচ্ছেন, মোদীর সতর্ক হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। মুম্বই হামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এখনও কার্যত কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি পাকিস্তান। জম্মু-কাশ্মীরে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের সন্ত্রাসও বন্ধ হয়নি। কেবল ভারতের মাটিতে নয়, বিদেশেও ভারতকে পাক জঙ্গিরা নিশানা করেছে বলে দাবি নয়াদিল্লির। মোদী প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচিত হওয়ার পরেই আফগানিস্তানের হেরাটে ভারতীয় দূতাবাসে হামলা চালিয়েছে জঙ্গিরা। শরিফ মোদীর আমন্ত্রণকে গুরুত্ব দিলেও পাক সেনা ও গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই মোদী সরকারকে পরীক্ষার মুখে ফেলতে চাইছে বলে ধারণা কূটনীতিকদের।
এই পরিস্থিতিতে শপথগ্রহণে আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের উপস্থিতিও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। নয়াদিল্লিতে মোদী-শরিফ-কারজাইয়ের এক মঞ্চে আসা জঙ্গিদেরও কড়া বার্তা দেবে বলেই আশা বিদেশ মন্ত্রকের। ২০১৪ সালেই আফগানিস্তান থেকে সেনা সরাবে ন্যাটো। তার পরে সে দেশের নিরাপত্তা দক্ষিণ এশিয়ার সব রাষ্ট্রপ্রধানেরই মাথাব্যথার বিষয়। কাল কারজাইয়ের সঙ্গেও বৈঠক করবেন মোদী। তিন রাষ্ট্রপ্রধানের উপস্থিতিকে ভারত কূটনৈতিক ভাবে ব্যবহার করতে চাইবে। কূটনীতির এই জটিল খেলায় মোদী কতটা সফল হন, সেটাই এখন দেখার।