গায়ে মোটা কাপড়ের পাঞ্জাবি। পরনে মোটা কাপড়ের ধুতি। পায়ে মোজা আর পাম্প স্যু। ৬ ফুটের কাছাকাছি লম্বা। মিতভাষী। অত্যন্ত বিনয়ী। অর্থাৎ বিনয় কোঙার, আনিসুর রহমান বা অনিল বসুর গোলার্ধে ওঁর ঠাঁই নেই। ভদ্রলোকের নাম বিনয় চৌধুরী। এ রাজ্যের বামপন্থী আন্দোলনের প্রথম সারির নাম। যাঁর নামে কোথাও কোনও কালি নেই। ১৯৫২ সালে রাজ্যের প্রথম বিধানসভা নির্বাচনে তিনি বর্ধমানে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হয়েছিলেন। সেই সময়ে পার্টির আরও কয়েক জন্য নেতার মতো বিনয় চৌধুরীকেও পুলিশ খুঁজছে। তাই তিনি আত্মগোপন করেছিলেন।
তিনি ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন বর্ধমানের মাহারাজার বিরুদ্ধে। ভাবা যায়! সেই সময়ে রাজাদের প্রতাপ খুব একটা কমেনি। তাই এলাকায় রাজাদের দাপট খুব বেশিই ছিল। তবু রাজাকে হারিয়ে আত্মগোপন করে থাকা অবস্থায় ভোটে জিতেছিলেন বিনয় চৌধুরী।
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্য তুলে ধরতে বামপন্থীরা অত্যন্ত ভরসা করে পঞ্চায়েতি রাজ ও ভূমিসংস্কারের উপর। এ ক্ষেত্রে বামপন্থীরা প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীর দেওয়া সার্টিফিকেটের কথাও ফলাও করে বলে। কিন্তু সেই সার্টিফিকেটের নেপথ্যে একটি ছোট্ট ঘটনা আছে। ১৯৮৬ সালে সল্টলেকের যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে পূর্বাঞ্চলীয় কংগ্রেস কর্মীদের সম্মেলন হয়েছিল। সেই সম্মেলনে এসেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী। সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে রাজীব গাঁধী এ রাজ্যের পঞ্চায়েতি রাজের প্রশংসা করেছিলেন। পঞ্চায়েতি রাজের সফল রূপকার হিসেবে জ্যোতি বসুর নাম করেছিলেন রাজীব গাঁধী। এই বিষয়ে প্রতিক্রিয়ায় জ্যোতি বসু বলেছিলেন, সফল পঞ্চায়েতি রাজের পিছনে গোটা বামফ্রন্টেরই অবদান রয়েছে। তবু যদি আলাদা করে কোনও ব্যক্তির নাম করতে হয় তাহলে বিনয় চৌধুরীর নাম করতে হবে।
বিনয় চৌধুরীই প্রথম দলের অসুখটা ধরতে পেরেছিলেন। রাজ্যের মন্ত্রী হওয়ার আগে পর্যন্ত বর্ধমানেই থাকতেন। কৃষকের জমির আন্দোলনেই জড়িয়ে ছিলেন। বর্ধমানের এক দলীয় সভায় ’৯০-এর দশকের গোড়ায় বিনয় চৌধুরী বলেছিলেন, ‘গাছ, মাছ আর কন্ট্র্যাক্টরে পার্টিটাকে খেল’। জন্মলগ্ন থেকে সিপিআইএম পার্টিটাকে যিনি দেখেছিলেন, সেই মানুষটার চোখ ভুল করেনি।
গাছ অর্থাৎ টিম্বার মাফিয়া, মাছ অর্থাৎ ভেড়ি আর কন্ট্র্যাক্টর এই ত্রিভুজে তখন থেকে ডোবা শুরু সিপিআইএম-এর। এই কথা বলে সে দিন অবশ্য হেনস্থার মুখে পড়তে হয়েছিল বিনয়বাবুকে। যে জ্যোতি বসু একদা তাঁকে পঞ্চায়েতি রাজের প্রধান কারিগর বলে প্রশংসা করেছিলেন, সেই জ্যোতি বসুই এই মন্তব্যের পরে বলেছিলেন, ‘পার্টির যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে উনি আছেন কেন’?
হয়তো এই অপ্রিয় সত্য ভাষণের জন্য দলে আজও তেমন চর্চিত নাম নয় প্রয়াত বিনয় চৌধুরী। দলের শুদ্ধিকরণ অভিযান নিয়ে অনেক কথা শোনা যায় বিমান বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখে। অনেক বিষয়ে ভুলও স্বীকার করেন বুদ্ধদেববাবু। কিন্তু সে দিন বিনয় চৌধুরীর বক্তব্য সম্পর্কে উদাসীন থাকা যে চরম ভুল হয়েছিল, সে কথা আজও স্বীকার করেননি। পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টির এটাই ট্র্যাজেডি। একদিকে কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে আবদুল্লা রসুল, বিনয় চৌধুরী, হরেকৃষ্ণ কোঙার ও মহম্মদ ইসমাইলের মতো নেতারা উঠে এসেছেন। অন্য দিকে, ভেড়ি দখলের মুন্সিয়ানা দেখিয়ে উত্তর ২৪ পরগনার শাসনের ত্রাস মজিদ মাস্টার, বীজপুরের জগদীশ দাস আর উত্তরবঙ্গের টিম্বার মাফিয়াদের নেতা বি ডি দাশদের হয়ে ওঠা।
পরবর্তী কালে অবশ্য মজিদ মাস্টার, বি ডি দাশরাই দলের ‘সম্পদ’ হয়ে ওঠেন। এই সম্পদদের দাপটেই ভোটের পর ভোটে নিশ্চিন্তে জয়। তাই এদের বাহিনী ভেড়ি লুঠ বা দখল করতে গিয়ে খুন, জখম করলে অথবা চোখের সামনে দিয়ে জঙ্গলের গাছ সাফাই করলেও পুলিশ নিধিরাম হয়ে বসে থাকত। সেই সময়ে এদের বিরুদ্ধে থানায় গিয়ে অভিযোগ করার সাহস কারও ছিল না। যদি সাহস থাকত তাহলে অভিযোগ জমে জমে যে পাহাড় তৈরি হত তাতে পুরুলিয়া ঘেঁষা বাঁকুড়ার শুশুনিয়ার বদলে এই পাহাড়েই রক ক্লাইম্বিংয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেত।
আজকে দু’হাতে পয়সা ওড়ানো জমিদারদের মতো আক্ষেপ করলে কী হবে, সে দিন যে সমস্ত নেতা, মন্ত্রীর আশীর্বাদে মজিদ মাস্টাররা নিশ্চিন্তে ছিলেন, তাদের সম্পর্কে আলিমুদ্দিন কিছুই জানত না, এ কথা শুনলে ঘোড়াও হাসবে। নেতা-মন্ত্রীদের প্রশ্রয়েই লালঝান্ডাধারী এক দল লুুঠেরা তৈরি হয়েছিল। উত্তরবঙ্গের অরণ্য-সম্পদ লুঠ বাড়ায় বাম আমলের বেশ কয়েক জন মন্ত্রীর সরাসরি মদত ছিল। বাম আমলের নেতা-মন্ত্রীদের চোখের মণি এক পুলিশ-কর্তা খিদমত খাটতে খাটতে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন। শেষ পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম বার রেলমন্ত্রী হওয়ার সময়ে শিবির পাল্টে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধরে রেলরক্ষী বাহিনীর কর্তা হয়েছিলেন।
কিন্তু মমতা হঠাৎ করেই রেল মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দেওয়ায় সেই পুলিশ-কর্তাকে ফের বাম সরকারের অধীনেই ফিরতে হয়। সেই সময় প্রতিশোধ নিতে তাঁকে আই জি ফরেস্ট পদে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সল্টলেকের অরণ্য-ভবনে তাঁর দফতর। দফতর বলতে পাঁচতলায় মোটামুটি একটি ঘর। বেল বাজালে অধস্তন কর্মী তো দূরের কথা, চা-জল দিতেও কেউ আসে না। শুধু অফিস যেতে-আসতে গাড়ি মেলে। তাও সপ্তাহে পাঁচ দিন। শনিবার, রবিবার অফিস বন্ধ। তাই ওই দু’দিন গাড়ি নেই। এই অবস্থায় অবসরের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ওই পুলিশ অফিসার কর্তার মুখে শুনেছিলাম পাল্টা প্রতিশোধ নেওয়ার কাহিনি।
সেই কাহিনি হল উত্তরবঙ্গে সেই সময়ে টিম্বার মাফিয়াদের নেতা ছিলেন এক মন্ত্রী-পুত্র। সেই মন্ত্রী-পুত্র যে বনসম্পদ উজার করছেন তা জানা ছিল জেলার পুলিশ-কর্তাদের। কিন্তু রাজতন্ত্র গিয়ে তার জায়গায় এসেছে গণতন্ত্র। আর বেনোজলে গণতন্ত্রে রাজশক্তি নয়, মন্ত্রী-শক্তির হাতেই সমাজের জিয়নকাঠি-মরণকাঠি। অতএব কে ছোঁবে মন্ত্রী-পুত্রকে। কিন্তু যে পুলিশ-কর্তা নেতা-মন্ত্রীদের বিষ নজরে রয়েছেন, প্রতিদিন হেনস্থার মুখে পড়ছেন, অবসরের মুখে দাঁড়িয়ে তাঁর তো পিছনে তাকানোর কিছু নেই। তাই প্রতিশোধ নিতে সেই মন্ত্রী-পুত্রের বেআইনী কাঠ বোঝাই ২১টি ট্রাক বাজেয়াপ্ত করেছিলেন তিনি। তখন তিনি নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন, ‘দ্যাখ কেমন লাগে!’ শোধ নেওয়ার তো একটা সুখ নিশ্চয়ই আছে!
রাজ্যের ভোট সংস্কৃতিতে সিপিআইএম-এর বড় অবদান সায়েন্টিফিক রিগিং। তার সঙ্গে রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন এবং রাজনৈতিক আধিপত্যকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন অসামাজিক কাজেও লালঝান্ডাধারীদের হাত ধরেই শিকড় গজিয়েছে। ৩৪ বছর ধরে লালঝান্ডাধারী একদল লুঠেরা নতুন ভোটারদের তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে তৃণমূলের দিকে। এখন আবার তাদের অনেকেই ‘পদ্ম’ ‘পদ্ম’ বলে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। তৃণমূলকে আনার সময় এরা জানত না কী তৃণমূলের অর্থনীতি, কী তাদের আদর্শ।
ঠিক তেমনই এরা এখনও জানে না বিজেপি-র লক্ষ্য ও আদর্শের কথা, কোন অর্থনীতির কথা বলে বিজেপি অথবা সেই দলের রাজনৈতিক স্লোগানের মধ্যে আমাদের মিলেমিশে থাকা সমাজ জীবনে বিপর্যয়ের কোনও ইঙ্গিত আছে কি না। তাদের এ সব ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তারা শুধু চারপাশে যা ঘটে চলেছে, তার পরিবর্তন চাইছে।
বাম আমলে শিল্পাঞ্চলের যুবক দেখেছে সারি সারি বন্ধ কারখানা। সেই বন্ধ কারখানার জমিতে পার্টি অফিসের প্রশ্রয়ে বহুতল নির্মাণ। অর্থাৎ প্রোমোটার রাজ। পার্টির নেতাদের প্রোমোটার বনে যাওয়া। কোনও কোনও বহুতলে প্রোমোটারের বদান্যতায় পার্টি অফিস তৈরি হওয়া। শহরাঞ্চল ও শহরের লাগোয়া প্রায় সর্বত্রই প্রভাবশালী নেতার ছত্রচ্ছায়ায় থাকা কমরেড বা হাফ-নেতারা একই ব্যাধিতে আক্রান্ত। কিছু কমরেড, কিছু হাফ-নেতা জমির দালালি, ঠিকাদারি, প্রোমোটারি, বাড়ি করার অনুমতি দিয়ে অর্থ আদায়, বিল্ডিং মেটেরিয়াল সাপ্লাই বা কালোয়ারি ব্যবসা, এমনকী সুদের ব্যবসা করার মতো পেশায় যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন।
আর গ্রামাঞ্চলে যে মোড়লতন্ত্রকে হঠিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়নের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, তাকেও উপরে ফেলে কমরেডদের হাত ধরে ফের মোড়লতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাও মানুষকে পরিবর্তন চাইতে বাধ্য করেছিল। ১৯৭৮ সালে প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে তৎকালীন সিপিআইএম-এর রাজ্য সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্ত বলেছিলেন, “গ্রাম পঞ্চায়েত হল এমনই একটি ধারালো অস্ত্র যা দিয়ে শত্রু পক্ষকে কাটতে কাটতে এগোনো যাবে। যদি ঠিক মতো ওই অস্ত্র ব্যবহার করা না যায়, তাহলে নিজেদের জখম হতে হবে।”
চুরুটসেবী প্রয়াত রাজ্য সম্পাদকের এই মন্তব্য ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে নিশ্চয় আলিমুদ্দিনের কর্তাদের মনে পড়েনি। পড়লে তাঁরা হয়তো সতর্ক হতেন। সে ক্ষেত্রে হয়তো আজকে নৌকা পুড়িয়ে ঘাটে নামার মতো অবস্থা হত না। বাম আমলের পার্টির প্রভাব খাটিয়ে অনিয়ম বা সামাজিক অপরাধ তো মানুষ চট ঘেরা টেবিলে রাখা মেশিনে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু যে আশায় তা করেছিলেন, তার কি আদৌ কোনও পরিবর্তন হয়েছে?
এই প্রশ্নের উত্তরে যদি না বলেন তাহলে ভুল হবে। বাম আমলের বেনিয়ম বা অসামাজিক কাজের মহীরুহগুলো রং পাল্টে একই থেকে গিয়েছে। অন্য দিকে চারাগাছগুলো মহীরুহ হয়ে উঠেছে। এই চারাগাছ থেকে মহীরুহ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াতে কিছু পরিবর্তন এসেছে। বাম আমলের চারাগাছ সিন্ডিকেটরাজ আর তোলাবাজি যেমন এখন মহীরুহে পরিণত হয়েছে, তেমনই ওই দুই অবৈধ বাবসায় অভিনবত্ব এসেছে।
বাম আমলে বাড়ি করতে গেলে বা কারখানা গড়তে গেলে পার্টি অফিস বা ইউনিয়নের দাপট দেখিয়ে তোলাবাজি চলত। এখন সে সব তো আছেই, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও অনেক কলাকৌশল। যেমন দমদম, বাগুইআটি, কেষ্টপুর, নিউটাউন বা রাজারহাট এলাকায় চলছে অদ্ভুত উপায়ে তোলাবাজি। ধরুন আপনি বাড়ি করছেন, আপনি প্রোমোটার হতে পারেন। আপনি বসবাসের জন্যও বাড়ি করতে পারেন। কিন্তু তোলা আপনাকে দিতেই হবে।
কেন দিতে হবে? কারণ আপনার নির্মীয়মাণ বাড়ি অথবা বহুতল বাড়িতে অসামাজিক কাজ চলছে। আপনি সেই কাজে মদত দিচ্ছেন।
কী রকম অসামাজিক কাজ চলছে? সন্ধ্যা নামলেই আপনার বাড়ি অথবা বহুতলে কিছু যুবক মদ্যপান ও জুয়ার আসর বসাচ্ছে। সমাজে তো এ সব চলতে পারে না। পুলিশে তো নালিশ করতেই হবে। একমাত্র উপায় স্থানীয় নেতাকে নগদ অর্থ ধরে দেওয়া। তা হলেই এড়ানো যাবে থানা-পুলিশ।
এ বার গোটা ঘটনার নেপথ্যে আসা যাক। আপনার নির্মীয়মাণ বাড়িতে বা বহুতলে যারা মদ্যপান ও জুয়ার আসর বসাচ্ছে, তারা সবাই ওই নেতার অনুগত সহচর। আবার ওই নেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে স্থানীয় থানার একাংশের। ফলে রমরমিয়ে চলছে এই অভিনব পন্থায় তোলাবাজি।
এত গেল শহর বা শহর লাগোয়া অঞ্চলের কথা। গ্রামে আবার তোলাবাজির চেহারা ভিন্ন। বাম আমলে বিরোধী পক্ষের লেবেল আটকে দিয়ে জরিমানা আদায় বা সামাজিক ভাবে একঘরে করে দেওয়া হত। দেখতে দেখতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সে সব এ আমলেও পরিবর্তনের পরে পরে অনেক হয়েছে। এখন একটু ভিন্ন চেহারা নিয়েছে।
কী রকম চেহারা নিয়েছে? আপনি হয়তো পরিবর্তনের পথেই ভোট দিয়েছেন অথবা দিয়েছিলেন। কিন্তু সরাসরি তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েননি। ব্যস, আপনি টার্গেট হয়ে যেতে পারেন। টার্গেট হলে প্রথমেই বলা হবে আপনি সিপিএম করতেন। অথবা আপনি সিপিএমকে ভোট দিয়েছেন। এখন অবশ্য বিজেপি বলেও দেগে দেওয়া হচ্ছে। এ বার আপনার যদি জমিতে ধান থাকে অথবা সব্জি থাকে, তাহলে সেই ফসল ঘরে তুলতে গেলে জরিমানা দিতে হবে।
কোথায় ঠিক হল আপনি সিপিএম বা বিজেপি করতেন কিংবা তাদের ভোট দিয়েছেন, সে সব প্রশ্ন অবান্তর। ধরা যাক আপনি পেশায় স্কুল শিক্ষক। সে ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে জরিমানা না দিলে স্কুলে গিয়ে কোনও একটি অজুহাতে আপনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানো হবে। নতুবা আপনার বিরুদ্ধে ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ তোলা হবে। পরিত্রাণের একমাত্র উপায় জরিমানা দিয়ে দেওয়া।
এ বিষয়ে হুগলির এক পুলিশ ইন্সপেক্টরের অভিজ্ঞতা আরও বিচিত্র। এক রাতে টহল দেওয়ার সময় চোখে পড়ে একদল লোক একটি বাড়ি ভাঙচুর করছে। পুলিশের কর্তব্য মেনে তিনি বাধা দিতে যান। এই অপরাধে ওই ইন্সপেক্টর ও তাঁর তিন সঙ্গী কনস্টেবলকে গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলা হয়। সে দিন রাতে স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধানের নির্দেশে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে উপ-প্রধানের বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হচ্ছিল। সেই কাজে বাধা দিয়ে গর্হিত অপরাধ করেছেন ওই ইন্সপেক্টর। তাই শাস্তিস্বরূপ সে দিন রাতে জরিমানা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি এবং কাগজে “আমি কয়েক জন দুষ্কৃতীকে নিয়ে গ্রামের একটি বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়েছি। আমি গ্রামবাসীদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।” এই মুচলেকা লিখে ছাড়া পান ওই পুলিশ ইন্সপেক্টর।
তবে এ কথা বলতেই হবে, তোলাবাজি, প্রোমোটার রাজ এবং সিন্ডিকেট-রাজ তৃণমূলের এই তিন বছরে শুরু হয়েছে এমন কথা বঙ্গের বিরোধীরাও বলছেন না। শুরু হয়েছে অন্তত পনেরো বছর আগে, সিপিএমের তুমুল সময়ে। তবে তখন একটা ন্যূনতম শৃঙ্খলা ছিল, সব কিছু এমন খুল্লাম-খুল্লা ছিল না। এবং এক জন দাদাকে তোলা দিলেই তা ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে যেত। এখন অনেক ‘দাদা’কে দিতে হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে শিল্পে-বিনিয়োগেও। অসুখটা সবার জানা। এবং অসুখটা তুচ্ছ নয়। তা সে মুখ্যমন্ত্রী মমতা যতই বলুন।
সংস্কৃতির সে কাল-এ কাল অথবা স্থাপত্যের সে কাল-এ কাল বিষয়ে বাজারে অনেক বই রয়েছে। এ বার বোধহয় তোলাবাজির এ কাল-সে কাল অথবা রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের সে কাল-এ কাল নিয়ে বই লেখার সময় এসেছে।
আবার বলতে হয়, হে বঙ্গ জননী, সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে!