ভূস্বর্গের ভালবাসার পদ্ম যাচ্ছে দেশ-বিদেশে

পদ্মপাতা জলে টলমল। ভোর হওয়া মাত্র রিয়াজ আহমেদের শিকারা চলেছে ডাল লেকের পদ্মবাগানের মধ্যে দিয়ে। বন্যায় ডাল লেক, ঝিলম ছাপিয়ে গেলেও হারিয়ে যায়নি যত্নে বানানো পদ্মবাগান। কিছু ফুল নষ্ট হয়েছে বটে। তার পরেও যত দূর চোখ যায় শুধু পদ্মপাতার সারি। তারই মধ্যে ফুটছে নতুন কুঁড়ি। দাঁতন করতে করতেই চোখ বুলিয়ে নেন রিয়াজ, জলের মধ্যে তারের বেড়া ঠিকঠাক আছে তো!

Advertisement

বিতান ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:২৩
Share:

শ্রীনগরের ডাল লেকে পদ্ম। —নিজস্ব চিত্র

পদ্মপাতা জলে টলমল। ভোর হওয়া মাত্র রিয়াজ আহমেদের শিকারা চলেছে ডাল লেকের পদ্মবাগানের মধ্যে দিয়ে। বন্যায় ডাল লেক, ঝিলম ছাপিয়ে গেলেও হারিয়ে যায়নি যত্নে বানানো পদ্মবাগান। কিছু ফুল নষ্ট হয়েছে বটে। তার পরেও যত দূর চোখ যায় শুধু পদ্মপাতার সারি। তারই মধ্যে ফুটছে নতুন কুঁড়ি।

Advertisement

দাঁতন করতে করতেই চোখ বুলিয়ে নেন রিয়াজ, জলের মধ্যে তারের বেড়া ঠিকঠাক আছে তো! পদ্মের সদ্য ফোটা কুঁড়ি এ বার পাড়ি জমাবে ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান। যাবে দিল্লি বা হায়দরাবাদেও। দুর্গাপুজোয় রিয়াজ আহমেদ, শাকিল আনসারি, জহুর আহমেদরা নিজেদের গ্রামের বাগানের পদ্মফুল পাঠাতে পেরেই খুশি। আর তার জন্য একটি পয়সাও দাম নেবেন না তাঁরা।

ডাল লেকের ২২ বর্গকিলোমিটার পরিধির মধ্যেই অবি কারপোরা গ্রাম। প্রায় ১৫০০ লোকের বাস। পলি জমে গজিয়ে ওঠা ছোট ছোট দ্বীপে বেশ কয়েকটি পাকা বাড়ি থাকলেও অধিকাংশেরই ভাসমান নৌকাঘর। এ গ্রামে হাট-বাজার, গ্রামসভার হল, ডাক্তারখানা সবই ভাসমান। অধিকাংশ বাসিন্দাই শিকারা চালান।

Advertisement

কারও কারও নিজস্ব হাউস বোট আছে, তবে পদ্ম আল লিলি চাষটা এখানে রেওয়াজ। গ্রামের সবাই ফুল ফোটাতে ভালোবাসেন। তাই কাজের ফাঁকেও পদ্মবাগানের খেয়াল রাখেন সকলেই।

পর্যটক নির্ভর এই অবি কারপোরা গত কয়েক বছর ধরেই বাণিজ্যিক ভাবে পিছিয়ে পড়ছে। শ্রীনগরের রাস্তায় দু’হাত অন্তর বর্ম আঁটা পুলিশ, একে ৫৭ আর ইনসাসের নল সকালের হালকা রোদেও চকচক করে। রাতে ভারি বুটের রুট মার্চের শব্দ শোনা যায়। “নিরাপত্তার কড়াকড়িতে পর্যটক এখন কমে গিয়েছে, তার উপর এ বার বন্যা আমাদের একেবারে শেষ করে দিল,” বললেন, প্রবীণ নাসিরুদ্দিন আহমেদ। নিজে এক সময়ে শিকারা বানাতেন, এখন ডাল লেকের এক তৃতীয়াংশ জুড়ে থাকা পদ্মবাগান দেখভাল করেন। নব্বই ছুঁই ছুঁই নাসিরুদ্দিনের নিজের দু’টো শিকারা ছিল। শর্মিলা ঠাকুর আর শশী কাপুর ‘কাশ্মীর কি কলি’ সিনেমায় সেই শিকারায় চেপেই শু্যটিং করেছিলেন। বৃদ্ধ হেসে বলেন, “ডাল লেকের পদ্মফুল আর লিলি দু’জনকে দিয়েছিলাম। খুব খুশি হয়েছিলেন তাঁরা। পর্যটকরা চাইলে আমরা পদ্মফুল উপহার দিই। কখনও পয়সা নিই না। ডাল লেকের এই পদ্মই বল আসলে কাশ্মীর কি কলি।”

‘কাশ্মীর কি কলি’-র এমন বিদেশ পাড়ি তবে কী ভাবে? পদ্মের গেঁড় তুলতে তুলতে রিয়াজ বলেন, ‘‘দুর্গা পুজোয় প্রতিবারই পদ্মের আকাল হয়, সে কলকাতাতেই হোক বা ক্যালিফোর্নিয়া। অথচ ডাল লেক ভরা শুধু পদ্ম আর পদ্ম। দেশ বিদেশের অনেক পর্যটকই এখানে এসে পদ্মফুল দেখে অবাক হয়ে যান। পুজোর সময় পদ্ম কী করে পাওয়া যাবে তার খোঁজ করেন।” রিয়াজ জানান, কিন্তু বিক্রির উপায় নেই তাঁদের। কারণ গ্রামের সংস্কার ডাল লেকের পদ্ম উপহার দেওয়া যাবে, বিক্রি করা যাবে না। রিয়াজ বলেন, “পুজোর জন্য যাঁরা পদ্মফুল চেয়েছিলেন, তাঁদেরও আমরা এমনিই পাঠাচ্ছি। কাশ্মীরের উপহার। শুধু নেওয়ার ব্যবস্থাটা তাঁদের করতে হচ্ছে।”

লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল থাকেন বাঙালি চলচ্চিত্রকার কোরক ঘোষ। গত বছর কাশ্মীরে একটি ছবির শু্যটিংয়ে গিয়ে ডাল লেকে পদ্মের বাগান দেখে তাঁর মাথায় আইডিয়াটা জাগে। বিদেশের পুজোয় কলকাতা থেকে ফাইবারের প্রতিমা যাচ্ছে, আর ডাল লেক থেকে কিছু পদ্মের কুঁড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে না? গোড়াতেই বিরস বদনে নিজেদের সংস্কারের কথা জানিয়ে কোরকবাবূুর উৎসাহে জল ঢেলে দিয়েছিলেন অবি কারপোরার বাসিন্দারা। একটিমাত্র পদ্মফুল উপহার দিয়েছিলেন তাঁরা কোরকবাবুকে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে আলাপ সেরে গাঁয়ের মানুষ অবশেষে রাজি হয়েছেন বিদেশে ফুল পাঠাতে। সংস্কার ভাঙার সেই খবর সোমবারই রিয়াজ আহমেদের কাছ থেকে ফোনে জেনে উচ্ছ্বসিত কোরকবাবু। বলেন, “বন্যার ধকল সয়েও কাশ্মীর আবার ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে, এটাই বড় কথা। আর এই সম্প্রীতির জন্যই কাশ্মীর আমার দেশের গর্ব।”

জহুর জানান, দেশ-বিদেশের বহু দুর্গাপুজো কমিটির উদ্যোক্তা বিভিন্ন সময় পদ্মফুলের জন্য যোগাযোগ করেছেন। তাঁদের কয়েক জনের ফোন নম্বর গ্রামবাসীদের কাছে ছিল। বন্যার পর টেলিফোন পরিষেবা একটু স্বাভাবিক হতেই তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফুল পাঠাতে চেয়েছেন জহুররা। সবাই খুব খুশি। দিল্লি বা জম্মুর অনেকে আবার জানিয়েছেন, পুজোর ঠিক আগে নিজেরাই গিয়ে ফুল নিয়ে আসবেন।

অবি কারপোরা এখন নতুন উৎসাহে টগবগ করে ফুটছে। ফুল ফোটানোর আনন্দ, ভালবাসার আনন্দ। জঙ্গি, গোলাগুলি, সেনাবুটের আওয়াজ ছাপিয়ে এ এক অন্য কাশ্মীর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন