হাতে গোনা আর মাত্র কয়েকটা দিন। তার পরেই দিল্লির ‘মজনু কা টিলা’য় কিশোর অপরাধীদের বিশেষ হোম থেকে ছাড়া পেতে চলেছে সে। ২০১২-র ১৬ ডিসেম্বর দিল্লির চলন্ত বাসে প্যারামেডিক ছাত্রী ‘নির্ভয়া’র উপরে সব চেয়ে বেশি অত্যাচার চালিয়েছিল উত্তরপ্রদেশের বদায়ুঁর এই ছেলেটাই।
বয়স তখনও ১৮ পূর্ণ হয়নি। তাই বাকিদের ফাঁসির সাজা হলেও কিশোর অপরাধীর চরিত্র সংশোধনের আইন মোতাবেক মাত্র তিন বছর হোমে থাকার ‘শাস্তি’ হয়েছিল তার। এখন সে ২১। তবে হোম থেকে ছাড়া পাওয়ার পরেও তাকে নজরবন্দি রাখার কথা ভাবা হচ্ছে বলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের খবর।
এর কারণ মূলত দু’টো। এক, ছেলেটি নতুন কোনও অপরাধ করতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। খুন-ধর্ষণ তো বটেই, নাশকতামূলক কাজকর্মেও জড়িয়ে পড়তে পারে সে। দুই, নির্ভয়া কাণ্ডের পর উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা দেশ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আশঙ্কা, নির্ভয়ার অন্যতম ধর্ষককে হাতের কাছে পেলে জনতার পুরনো ক্ষোভ মাথাচাড়া দিতে পারে। অপ্রীতিকর কিছু ঘটে যাওয়াও অসম্ভব নয়। মূলত এই আশঙ্কা থেকেই তাকে নজরবন্দি রাখার ভাবনা।
নির্ভয়ার বাবা-মা অবশ্য অনেক আগেই জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে আর্জি জানিয়েছেন, ছেলেটিকে যেন মুক্তির পরেও নজরবন্দি রাখা হয়। চিঠিতে তাঁরা লিখেছেন, ‘আমাদের মেয়ের মৃত্যুর জন্য এই ছেলেটিই অনেকাংশে দায়ী। সব দোষীদের মধ্যে ও-ই ছিল সবথেকে ভয়ঙ্কর ও নির্মম। এই ধরনের মানুষ সাধারণ মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক। তাই এদের কড়া নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা উচিত, যাতে আর কারও কোনও ক্ষতি না হয়।’
নির্ভয়ার বাবা-মায়ের আর্জি পেয়ে দিল্লি সরকার, দিল্লি পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে মানবাধিকার কমিশন জানতে চেয়েছে, ওই অপরাধীকে হোম থেকে মুক্তি দেওয়া নিয়ে কী ভাবছে তারা। দিল্লির মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিবের কাছে ওই অপরাধীর মানসিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে। সম্প্রতি তার মানসিক অবস্থার পর্যালোচনা হয়ে থাকলে, সেই রিপোর্টও চেয়েছে কমিশন।
সেই পর্যালোচনা ইতিমধ্যেই হয়েছে। কারণ, ওই হোমে থাকার সময়েই ওই সদ্য-তরুণকে নিয়ে দেখা দেয় অন্য এক আশঙ্কা। সে কথা সবিস্তার রয়েছে গোয়েন্দা রিপোর্টে। যে রিপোর্ট বলছে, হোমে নির্ভয়ার নাবালক ধর্ষকের সঙ্গে একই সেলে থাকত এক কাশ্মীরি। ২০১১-য় দিল্লি হাইকোর্টে বিস্ফোরণের ঘটনায় জড়িত এই ছেলেটিকে কিস্তওয়ার থেকে যখন গ্রেফতার করা হয়েছিল, তখন সে-ও ছিল নাবালক। গোয়েন্দাদের দাবি, একই সেলে থাকর সময়ে বদায়ুঁর ছেলেটির মগজ ধোলাই করে কাশ্মীরিটি। ছাড়া পাওয়ার পর সে জেহাদে নাম লেখাবে বলেও নাকি তাকে প্রতিশ্রুতি দেয় নির্ভয়ার ধর্ষক!
এই গোয়েন্দা রিপোর্ট পাওয়ার পরেই কাশ্মীরের ছেলেটিকে অন্য হোমে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। নির্ভয়ার ধর্ষকের মগজ থেকে জেহাদের বিষ নামাতে সাহায্য নেওয়া হয় মনোবিদদের। যদিও এই পাল্টা-মগজ ধোলাইয়ে কতখানি লাভ হয়েছে, সে বিষয়ে কেউই নিশ্চিত নন। নারী ও শিশু কল্যাণমন্ত্রী মেনকা গাঁধী মনে করছেন, নির্ভয়া-কাণ্ডের মতো ভয়াবহ ঘটনার অন্যতম অপরাধীকে যেখানে খুশি যেতে দেওয়া ঠিক নয়। ঘটনা হল, ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে ওই ‘নাবালক’ ধর্ষককে যখন তার মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হবে, তখন তার পুনর্বাসন বাবদ নিয়মমাফিক ২০ হাজার টাকাও দিতে হবে সরকারকে!
গোটা বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গে মেনকা ইতিমধ্যেই কথা বলেছেন বলে খবর। নির্ভয়া-কাণ্ডের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে ১৬ থেকে ১৮ বছরের অভিযুক্তদেরও যাতে ভারতীয় দণ্ডবিধি ও ফৌজদারি আইনে বিচার হয়, সেই লক্ষ্যে কিশোর অপরাধ আইন সংশোধন করে বয়সসীমা কমিয়ে আনছে নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রক। মে মাসে লোকসভায় এই সংক্রান্ত বিল পাশ হয়েছে। সংসদের আসন্ন শীতকালীন অধিবেশনে রাজ্যসভাতেও বিলটি পাশের আশা করছে নরেন্দ্র মোদী সরকার।
নির্ভয়া কাণ্ডে ফাঁসির সাজা প্রাপ্ত পাঁচ জন ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে। এক জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে জেলেই। ‘নাবালক’ ধর্ষকের বন্দিদশা খাতায়-কলমে ১৫ ডিসেম্বর শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত দিনের সপ্তাহখানেক আগেই সে ছাড়া পেতে পারে বলে সূত্রের দাবি। যখনই সে ছাড়া পাক, তাকে দেখতে হোমের বাইরে ভিড় জমার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছে দিল্লি প্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। সেই ভিড়ভাট্টার মধ্যে যাতে অনভিপ্রেত কিছু না ঘটে, তা মাথায় রাখতে হচ্ছে কর্তাদের। এই পরিস্থিতিতে মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, মুক্তির পরেও ওই অপরাধীর উপরে নজর রাখার পরিকল্পনার কথাই তারা জানাতে চলেছে মানবাধিকার কমিশনকে।