তাজমহল নিয়ে সুখেই ছিলেন ‘শাহজাহান’। খামোখা ‘অরণ্যদেব’ সেজে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে লড়তে নেমে হাজতে যেতে হল তাঁকে!
সম্প্রতি ঘটনাটি ঘটেছে মিজোরামে।
নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে মুখ্যমন্ত্রী লাল থানহাওলার মোবাইল ফোনে কয়েকটি এসএমএস পাঠানো হয়েছিল। প্রেরকের নাম ‘ফ্যান্টম’ (বাংলায়, অরণ্যদেব)। পুলিশের বড়কর্তাদের সব কথা জানান মুখ্যমন্ত্রী। শুরু হয় তদন্ত।
পুলিশ জানতে পারে, ওই ‘ফ্যান্টম’ আসলে খলহ্রিং চাওংথুয়ামা। মিজোরামে তিনি ‘শাহজাহান’ নামে পরিচিত। প্রয়াত স্ত্রীর স্মৃতিতে চাওংথুয়ামার তৈরি সৌধ মিজোরামবাসী এবং পর্যটকদের কাছে ‘আইজলের তাজমহল’ নামে খ্যাত।
চাওংথুয়ামা এবং তাঁর স্ত্রী ভার্তে শিক্ষক ছিলেন। চাওংথুয়ামা যাজকও। দু’জনে মিলে আইজলে স্কুলও গড়েছিলেন। ২০০১ সালে ডার্টলং পাহাড়ে গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ভার্তের। দুর্ঘটনাস্থলে স্ত্রীর স্মৃতিতে তিন তলা সৌধ নির্মাণ করেন চাওংথুয়ামা। ২০১০ সালে তাঁর এক সন্তানও মারা যায়। ওই সৌধেই তিনি স্ত্রী এবং সন্তানকে সমাধিস্থ করেন। সেখানে রাখা হয় বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির শোকবার্তা, স্ত্রী এবং পরিবারের ছবি, ভার্তের জ্যাকেট, শাল, জুতো, ব্যাগ, জামাকাপড়। আইজলে যাওয়া পর্যটকদের ভ্রমণ তালিকায় থাকে আইজলের সেই ‘তাজমহল’।
এমন প্রেমের সৌধের নির্মাণকারী চাওংথুয়ামাকে, মুখ্যমন্ত্রীর মোবাইলে অশালীন এসএমএস পাঠানোর দায়ে পুলিশ হাজতে রাখা হল। আদালতে জামিন পেয়ে ফের সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন চাওংথুয়ামা। তিনি বলেন, “কংগ্রেস অন্যায় ভাবে নির্বাচনে জিতছে। পর্যাপ্ত প্রমাণ আমার হাতে রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীও তা জানেন। তাই আমাকে ভয় পাচ্ছেন।”
আচমকা মুখ্যমন্ত্রী লাল থানহাওলার উপর কেন চটলেন ওই ধর্মযাজক?
স্থানীয় সূত্রে তার ব্যাখ্যাও শোনা গিয়েছে। মিজোরামে ভোট মানেই ধর্ম বনাম রাষ্ট্রের লড়াই। নির্বাচন চলাকালীন রাষ্ট্রযন্ত্রকে গির্জার সঙ্গে টক্কর দিতে হয়। ভোট মানেই সেখানে গির্জা ও ধর্ম সংগঠনের একের পর এক ফতোয়াস্লোগান নয়, দল বেঁধে প্রচার চলবে না, ঘোরা যাবে না বাড়ি-বাড়ি। তবে, পাড়ায় মঞ্চ তৈরি করে প্রার্থীদের নিজের বক্তব্য এক বার করে পেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়। না-হলে কেব্ল টিভি এবং এসএমএস ভরসা।
এ রকম পরিস্থিতিতে, গত বিধানসভা ভোটে ইভিএম নিয়ে বিস্তর অভিযোগ ওঠে মিজোরামে। লাল থানহাওলার নেতৃত্বে কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও, বিরোধীরা দাবি করেন, ইভিএমে কারচুপি করা হয়েছে। অভিযোগের জেরে, এ বার রাজ্য নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকা ইসিআইএল নির্মিত ইভিএম বদলে দিয়ে লোকসভা ভোটের জন্য ভেল-এর ইভিএম নিয়ে আসা হচ্ছে। বিরোধীরা নির্বাচন কমিশনে এ বিষয়ে যত অভিযোগ করেন, গির্জার কাছে নালিশ ঠুকেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি। এ সবের মধ্যেই দুর্গাপুজোয় কলকাতায় গিয়ে কপালে ফোঁটা কেটে গির্জাকে আরও চটিয়ে দেন থানহাওলা। চাওংথুয়ামার পদক্ষেপ তারই ফলশ্রুতি।
সব কিছু জেনে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “উনি (চাওংথুয়ামা) প্রবীণ যাজক, ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। নামী স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। স্ত্রীর স্মৃতি বিক্রি করেও তাঁর রোজগার হয়। কিন্তু, আমাকে অশালীন এসএমএস পাঠানোয়, বাধ্য হয়ে আইনের পথে হাঁটতে হয়েছে।”
তিনি জানান, চাওংথুয়ামা গ্রেফতার হওয়ার পরই, ধৃতের পরিজনরা ক্ষমা চাইতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, তত ক্ষণে ওই যাজককে পুলিশ হেফাজতে পাঠানো হয়ে গিয়েছিল। পরে প্রেসবিটেরিয়ান গির্জার এক প্রবীণ যাজককে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠান চাওংথুয়ামা।
লাল থানহাওলার কথায়, “বিষয়টি এখন আমার ক্ষমা করা, না-করার জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। এসএমএসে শুধু মুখ্যমন্ত্রী বা কংগ্রেস নয়, জেলা শাসক, নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ তোলা হয়েছে। আইন আইনের পথে চলবে।”
পুলিশ সূত্রের খবর, চাওংয়ের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধি এবং তথ্য-প্রযুক্তি আইনে মামলা করা হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত কি মোগল সম্রাটের মতোই, তাজমহলের স্মৃতি আঁকড়ে চাওংকেও জেলেই দিন কাটাতে হবে?