মোদীর পথে কাঁটা ছড়াতে উদ্যোগী সঙ্ঘ

প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নের বার্তাই সার! মহারাষ্ট্রের ক্ষমতায় এসে সেই হিন্দুত্বের পথেই হাঁটার সিদ্ধান্ত নিল রাজ্যের বিজেপি সরকার। সে রাজ্যে এক সপ্তাহের মধ্যে পর পর ঘটে গিয়েছে দু’টি ঘটনা। প্রথমে আইন করে গো-হত্যা বন্ধ হয়েছে এবং পরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে মুসলিম ছেলে-মেয়েদের আসন সংরক্ষণ বাতিল করে দিয়েছে সরকার। আর এ সব সিদ্ধান্তের পিছনে সঙ্ঘ পরিবারের হাত দেখছেন বিরোধীরা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৫ ০২:৫৭
Share:

প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নের বার্তাই সার! মহারাষ্ট্রের ক্ষমতায় এসে সেই হিন্দুত্বের পথেই হাঁটার সিদ্ধান্ত নিল রাজ্যের বিজেপি সরকার। সে রাজ্যে এক সপ্তাহের মধ্যে পর পর ঘটে গিয়েছে দু’টি ঘটনা। প্রথমে আইন করে গো-হত্যা বন্ধ হয়েছে এবং পরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে মুসলিম ছেলে-মেয়েদের আসন সংরক্ষণ বাতিল করে দিয়েছে সরকার। আর এ সব সিদ্ধান্তের পিছনে সঙ্ঘ পরিবারের হাত দেখছেন বিরোধীরা।

Advertisement

ক্ষমতায় আসার পরেই নরেন্দ্র মোদীর যুক্তি ছিল মেরুকরণের রাজনীতির তলায় যেন উন্নয়ন চাপা না পড়ে যায়। হিন্দুত্বের পরিবর্তে উন্নয়ন ও বিকাশই হবে তাঁর মূলমন্ত্র-- একাধিক বার এই বার্তাও দেন সঙ্ঘ পরিবারকে। এমনকী ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রশ্নে বিতর্ক তৈরি হলে বাজেট অধিবেশনের ঠিক আগে মুখ খোলেন তিনি। কিন্তু মহারাষ্ট্র সরকারের সিদ্ধান্ত দেখিয়ে দিল, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বিজেপি পড়ে রয়েছে হিন্দুত্বের লাইনেই। ওই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে দলের একাংশের ব্যাখ্যা, মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই সঙ্ঘের একাংশ নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা হারানোর আশঙ্কা করছিল। এর পর লোকসভা ভোট আর একের পরে এক রাজ্যে ক্ষমতা দখল করে মোদী-অমিত শাহ জুটি ক্রমশ প্রভাব বাড়াতে শুরু করেছিলেন সঙ্ঘের অভ্যন্তরেও। গত নয় মাসে দল ও সঙ্ঘের মধ্যে মতপার্থক্য একাধিক বার প্রকাশ্যেও চলে এসেছে। এখন দিল্লিতে ভরাডুবির পরে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটিকে ধাক্কা দিতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সঙ্ঘ পরিবার।

সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস আইন করে গো-হত্যা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কুড়ি বছর আগে ওই বিলটি মহারাষ্ট্র বিধানসভায় পাশ হলেও চলতি সপ্তাহে সেটিকে আইনে পরিণত করেছে বিজেপি-শিবসেনা সরকার। গোটা দেশেই আইন করে গো হত্যা বন্ধ করে দেওয়ার দাবি সঙ্ঘের নতুন নয়। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে এই আইন চালু করতে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় রয়েছে সঙ্ঘ। তবে ওই সিদ্ধান্তের পিছনে হিন্দুত্বের রাজনীতি থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে মহারাষ্ট্র সরকার জানিয়েছে, কৃষকদের স্বার্থের কথা ভেবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে গরুর মাংসের ব্যবসাও। ফলে রুটি-রুজির প্রশ্নে সমস্যায় পড়তে চলেছেন সংখ্যালঘু সমাজের মানুষেরা। যারা মূলত মাংসের ব্যবসা ও চামড়ার কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার কথা ভাবছে ওই পেশার সঙ্গে যুক্ত একাধিক সংগঠন।

Advertisement

অন্য দিকে ওই সিদ্ধান্ত আসার দু’দিনের মাথায় মহারাষ্ট্রের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে মুসলিমদের জন্য ৫ শতাংশ আসন সংরক্ষিত রাখার যে নিয়ম রয়েছে তা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যদিও বহাল রয়েছে মরাঠাদের জন্য ১৫ শতাংশ আসন সংরক্ষণের নীতি। সরকারের যুক্তি, অনগ্রসর বলেই মরাঠাদের জন্য সংরক্ষণ চালু থাকছে। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মের ভিত্তিতে যে ভাবে মুসলিমদের সংরক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, তা সংবিধান বিরোধী। তাই তা বাতিল করা হয়েছে। উদ্দেশ্য স্পষ্ট, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে মেরুকরণের বার্তা দেওয়া। ইতিমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছেন বিরোধীরা। কংগ্রেস নেতা মণীশ তিওয়ারি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী সহিষ্ণুতার বার্তা দিলেও বাস্তবে সঙ্ঘ পরিবারের হাতেই যে বিজেপির চাবিকাঠি রয়েছে, তা স্পষ্ট। হঠাৎ করে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনও অর্থ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”

সংসদে যখন বাজেট অধিবেশন চলছে তখন এ ধরনের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের প্রশ্নে দ্বিমত রয়েছে বিজেপিতেও। ভবিষ্যতে রাজ্যসভায় বিরোধী দলগুলিকে এক জোট করে সরকারের ব্যাখ্যা দাবি করারও রণকৌশল নিচ্ছে তৃণমূল শিবির। অন্য দিকে বিজেপিতে অরুণ জেটলির মতো নেতারা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। দলের একাংশের বক্তব্য, ব্যক্তিগত ভাবে মোদী মেরুকরণের রাজনীতির বিরুদ্ধে। এখন তাঁর প্রধান লক্ষ্য দেশের বৃদ্ধি ও বিকাশ। দেশকে যদি উন্নয়নের রাস্তায় নিয়ে যেতে হয়, তা হলে এই ধরনের মেরুকরণের রাজনীতিকে বিদায় জানাতে হবে, তা তিনি বিলক্ষণ জানেন। বিজেপি নেতাদের অনেকেই মনে করেন, লোকসভা নির্বাচনে ধর্মীয় মেরুকরণের বিষয়টি বিজেপিকে ভাল ফল করতে সাহায্য করেছিল ঠিকই কিন্তু ক্ষমতায় এসেই গত ন’মাসে উন্নয়নের কথাকেই সামনে আনতে চাইছেন মোদী। এমনকী দিল্লিতে জনমোহিনী নীতির পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের লক্ষ্য স্থির করে মানুষের কাছে ভোট চেয়েছিলেন তিনি। তবে সঙ্ঘ নেতারা বিভিন্ন সময়ে হিন্দুত্ববাদী প্রচার করে মানুষের মনে সংশয় তৈরি করেছেন। সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতির ‘হারামজাদা’ মন্তব্য কিংবা সাক্ষী মহারাজের চার সন্তানের যুক্তি উল্টো প্রভাব ফেলেছে মানুষের মনে।

আর তাই মেরুকরণের রাজনীতি বিসর্জন দিয়ে দলের নেতাদের ধর্মীয় অসহিষ্ণু মন্তব্যের ধাক্কা সামলাতে মুখ খুলছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। অবশ্য বিরোধীদের বক্তব্য, উপায়ও ছিল না মোদীর কাছে। দিল্লি নির্বাচনে পরাজয়, হিন্দুত্ববাদী মন্তব্যে লোকসভার অধিবেশন ভেস্তে যাওয়া ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রশ্নে মার্কিন প্রেসিডেন্টের খোঁচায় রীতিমতো অস্বস্তিতে পড়ে যান বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। পরিস্থিতি প্রতিকূল বুঝেই মোদীর বিবৃতি। বাজেট অধিবেশনের আগে আন্তর্জাতিক মহলকে বার্তা দেওয়ার পাশাপাশি দিল্লি পরাজয়ের পিছনে সঙ্ঘ পরিবারের কট্টর লাইনও যে দায়ী, তা-ও বুঝিয়ে দেন মোদী। জানান, সরকার ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাধীনতা পুরোপুরি সুনিশ্চিত করবে। এমনকী বিজেপি সাংসদদের এ বিষয়ে মুখ বন্ধ রাখার পরামর্শ দেন তিনি। দলীয় বৈঠকে বার্তা দিয়ে বলেন, মেরুকরণের রাজনীতি নয়, উন্নয়ন ও সুশাসনকে মূলধন করে তিনি এগোতে চান। এমনকী হিন্দুত্ব বিতর্কের জেরে দেশের অর্থনীতিও যে মার খাচ্ছে, সেই বার্তাও আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতকে দেন মোদী। ফলে সাময়িক ভাবে ছেদ পড়ে মেরুকরণের রাজনীতিতে।

কিন্তু সেই বিরতি যে সাময়িক ছিল এবং উভয় পক্ষের ছায়াযুদ্ধ যে পূর্ণমাত্রায় চালু রয়েছে, তা ফের স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে মহারাষ্ট্র সরকারের দুটি সিদ্ধান্তে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন