দিদিমার কাছে নাতির আহ্লাদ বেশি থাকেই। কিন্তু, দিল্লির কালীতারা মণ্ডল এবং গুয়াহাটির সত্যভামা দাস ইন্দিরা গাঁধীর অন্ধ ভক্ত হলেও, দেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ইন্দিরার নাতির উপরে তাঁদের ভরসা নেই!
দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কের বাসিন্দা কালীতারা দেবী ১০৬ বছর বয়সেও ভোট দিয়েছেন। গুয়াহাটির উলুবাড়ির সত্যভামাদেবী আপাতত প্রস্তুত হচ্ছেন ২৪ এপ্রিলের জন্য। তিনিই যে উত্তর-পূর্বের সম্ভবত প্রবীণতম ভোটার। তাঁর আত্মীয় থেকে পড়শি সকলে বলছেন, প্রয়োজনে চেয়ারে বসিয়ে তাঁকে বুথে নিয়ে যাওয়া হবে।
শ্রীহট্টের হবিগঞ্জে জন্ম। ১১০ বছরের বৃদ্ধার মেজ ভাই সুধীরকুমার রায়ও শতবর্ষ পার করেছেন। তিনি করিমগঞ্জের ভোটার। ভাইয়ের চেয়ে দিদি ৮ বছরের বড়। সত্যভামাদেবীর মেয়েদের মধ্যে মেজ সরযূদেবী চাকরি করতেন। বড় মেয়ে মারা গিয়েছেন। অন্য দুই মেয়ে গুয়াহাটিতেই আছেন। ছেলে থাকেন নয়ডায়। সরযূদেবী ১৯৯৪ সালে, গুয়াহাটির হ্যান্ডিক কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবে অবসর নেন। অশীতিপর মেয়ে আর মায়ের ছোট্ট সংসার উলুবাড়ির রাজ আবাসনের ২০৮ নম্বর ফ্ল্যাটে। তবে, বয়সের ভার শরীরে ছাপ ফেললেন, ডক্টরেট মেয়ে আর রাজনীতি-সচেতন মায়ের সংসারে মূল বিনোদনই হল টিভিতে সংবাদ দেখা আর রাজনীতির আলোচনা। খাবার বলতে ডাল-ভাত, ছোট মাছের ঝোল। প্রতিবেদকের আদি বাড়ি বাংলাদেশ শুনে উত্তেজনায় উঠে বসলেন সত্যভামাদেবী। ‘দ্যাশের ভাষা’য় জিজ্ঞাসা করলেন নানা কথা। খুলে গেল গল্পের ঝাঁপিও।
১১ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। সত্যভামাদেবী গর্বের সঙ্গে জানান, স্বামী নিকুঞ্জবিহারী দাস তখনকার দিনে গুয়াহাটির ‘আর্ল ল কলেজ’ থেকে পাস করা উকিল ছিলেন। স্বামীর কাছেই ম্যাট্রিক অবধি লেখাপড়া শেখা সত্যভামাদেবী বাড়ির সব বাচ্চাদের প্রাথমিক পাঠ দিতেন। মেয়ে বলেন, “মা এত কড়া ছিলেন, আমরা সব সময় ভয়ে থাকতাম। সব কাজ হতে হবে পরিপাটি।”
দেশ ভাগের পরেও ভিটে আঁকড়ে পড়েছিলেন স্বামী-স্ত্রী। তাঁর স্মৃতিতে এখনও টাটকা গোষ্ঠী সংঘর্ষের আগুন, হত্যালীলা। সরযূদেবী ততদিনে গুয়াহাটিতে বিটি পড়ছেন। হিন্দি প্রচার সমিতিতে ৮৫ টাকা বেতনে কাজ পান তিনি। ৫৩ সালে পান শরণার্থী জলপানি। সেই জলপানির ৪০০ টাকা থেকে ৩৭৫ টাকা খরচ করে, গুয়াহাটির বিষ্ণুপুরে দেড় কাঠা জমিতে বাড়ি তোলেন সরযূদেবী। ১৯৫৪ সালে, পাকাপাকিভাবে মা-বাবাকে নিয়ে আসেন এখানে। ১৯৫৭ সাল থেকে সত্যভামাদেবী অসমে ভোট দিচ্ছেন। শিলচরের অধরচন্দ্র হাইস্কুল সত্যভামাদেবীর বাবার নামাঙ্কিত।
স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বাড়িতেও লাগে স্বদেশীর ঢেউ। চালু হয় চরকা কাটা, খদ্দর পরা। কংগ্রেস তখন থেকেই মনের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। এত বছর কংগ্রেস ছাড়া তাই অন্য কাউকে ভোট দেওয়ার কথা ভাবতেই পারেননি শতায়ু বৃদ্ধা।
বছর দুই আগে ছানি অপারেশন করানো সত্যভামাদেবী বলেন, “দেশে আর আগেকার নেতা-নেত্রীরা কোথায়? নেই মূল্যবোধ। অরাজকতা চলছে। ইন্দিরার মতো প্রধানমন্ত্রী চাই।” কিন্তু, ইন্দিরা নেই তো কী, তাঁর নাতি তো আছেন। সত্যভামাদেবীর মতে, রাহুল ছেলে ভাল হলেও, দেশে এখন শক্ত হাতের নেতা চাই। তাই আপাতত তিনি নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে। কেজরিওয়াল যে ভাবে দুর্নীতির সঙ্গে লড়াই করছেন তা-ও সত্যভামাদেবীর খুব পছন্দ। ভোটার তালিকার তাঁর নাম ও ছবির পাশে ১১০ বছর বয়স লেখা রয়েছে। সত্যভামাদেবী বলেন, “অসমে এসে গোপীনাথ বরদলৈ-সহ কত পুরনো, সৎ নেতাকে কাছ থেকে দেখেছি। এখন তো চারদিকে কেবল লোভ আর ক্ষমতার লড়াই।” তবু এগারো দশক পার করা বৃদ্ধা বুথে যাওয়ার কথাই জানালেন।