বিদায়বেলায় গুজরাত বিধানসভায় বক্তৃতা মোদীর। ছবি: পিটিআই।
পাকিস্তানের নওয়াজ শরিফ। বাংলাদেশের শেখ হাসিনা। শ্রীলঙ্কার মহেন্দ্র রাজাপক্ষে। আফগানিস্তানের হামিদ কারজাই। নেপালের রামবরণ যাদব। ভুটানের শেরিং তোবগে। মলদ্বীপের মহম্মদ নাসিদ।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইনিংস শুরু করার আগেই দৃষ্টান্ত গড়লেন নরেন্দ্র মোদী। আগামী ২৬ তারিখ তাঁর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আসার জন্য সার্কের প্রতিটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে আজ সন্ধেবেলা চিঠি পাঠানো হয়েছে। ঘটনাটি অভিনব, কেন না ভারতের ইতিহাসে এমন আমন্ত্রণ এর আগে কোনও হবু প্রধানমন্ত্রীই জানাননি।
মোদীর আমন্ত্রণ পেয়ে প্রতিবেশী দেশগুলি মোটের উপর খুশি। কারজাই ও রাজাপক্ষে ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁরা আসছেন। বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রের খবর, ওই সময় জাপান সফরে যাওয়ার কথা আগে থেকেই ঠিক থাকায় শেখ হাসিনা আসতে পারছেন না। পাঠাচ্ছেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরিকে। তবে আসার সম্ভাবনা রয়েছে পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের। দিল্লির পাক দূতাবাস সূত্রে জানানো হয়েছে, ২৬ তারিখ শরিফের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা। সেই অনুষ্ঠানসূচি পাল্টানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। একান্তই বদলানো না গেলে, তাঁর প্রতিনিধি হয়ে আসবেন জাতীয় নিরাপত্তা ও বিদেশনীতি সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সরতাজ আজিজ। এ দফা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে ভারতে আসেননি শরিফ। এ বার এলে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে তা নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
কূটনীতিক মহলের বক্তব্য, এই আমন্ত্রণ পাঠিয়ে মোক্ষম কূটনৈতিক চাল চেলেছেন মোদী। অগ্নিগর্ভ বলয়ের মধ্যে থেকে মনমোহন সরকার প্রতিবেশী কূটনীতি সামলাতে গত দশ বছরে কার্যত ব্যর্থ। পাকিস্তান নিয়ে সম্পর্কের পারদ ক্রমশ চড়েছে, ঘটেছে একের পর এক বিস্ফোরণ ও সীমান্ত-হত্যার ঘটনা। তামিল আবেগ এবং জাতীয় স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য ঘটাতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়েছে শ্রীলঙ্কা-নীতি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর দ্বিতীয় দফায় এক বারও কলম্বো যাননি। হাসিনাকে কথা দেওয়া সত্ত্বেও স্থলসীমান্ত চুক্তি এবং তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়িত করতে পারেনি কেন্দ্র। নেপাল এবং মলদ্বীপেও অশান্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জাতীয় স্বার্থ।
এই পরিস্থিতিতে মোদীর এই উদ্যোগ প্রতিবেশী কূটনীতি তথা দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক স্বার্থকে একজোট করার পক্ষে তাৎপর্যপূর্ণ। আজ একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, ‘অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’-এর রাজনৈতিক গবেষক এম সত্যমূর্তি বলেন, “মোদী এই বার্তা দিতে চাইছেন যে, গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তা এবং বাণিজ্যিক সঙ্কটকে না এড়িয়ে গোড়া থেকেই তার মুখোমুখি হতে হবে।” বিজেপি শিবিরের দাবি, গত দশ বছর ধরে মনমোহন সিংহ তাঁর বিদেশনীতিতে সার্ক দেশগুলিকে গুরুত্ব না দিয়ে আমেরিকার সঙ্গে কৌশলগত ও আর্থিক সম্পর্কএগিয়ে নিয়ে যাওয়াকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ফলে নখদন্তহীন হয়ে পড়েছে সার্ক। আজ যখন পশ্চিমের অনেক দেশই আর্থিক মন্দায় জেরবার, তখন দক্ষিণ এশিয়াকে সঙ্ঘবদ্ধ করে নতুন দিশার সূচনা করতে চান মোদী। প্রোটোকল অনুযায়ী এই রাষ্ট্রনেতারা শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে এলে তাঁরা নতুন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাদা করে বৈঠক করবেন। সে ক্ষেত্রে ২৭ তারিখেই বেশ ক’টি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের সম্ভাবনা রয়েছে।
পাকিস্তানকে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টিকেই সব চেয়ে বড় করে দেখছে রাজনৈতিক শিবির। মোদীর জয়ের পরে শরিফ নিজেই ফোনে তাঁকে ইসলামাবাদে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছেন। আজ শরিফের কাছে পাল্টা আমন্ত্রণবার্তা পাঠানোর পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন ওমর আবদুল্লা, মেহবুবা মুফতি-সহ কাশ্মীরের বিভিন্ন শিবিরের নেতারা। পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘদিন বরফ জমে রয়েছে। মুম্বই সন্ত্রাসে অভিযুক্তদের দ্রুত শাস্তি দেওয়ার দাবি নিয়ে তিক্ততা চরমে উঠেছে। সীমান্তে ভারতীয় সেনার মুণ্ডচ্ছেদের ঘটনাও ঘটেছে। এ সবের জেরে ২০১২ সালে তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণর পাক সফরের পরে আর কোনও শীর্ষ পর্যায়ের সফর দু’দেশের মধ্যে হয়নি।
অবশ্য গত বছর সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীর দেখা হয়েছে। তখন সীমান্তে হত্যার ঘটনা নিয়ে তদন্ত করার কথা দিয়েছিলেন নওয়াজ, কিন্তু আলোচনা আর এগোয়নি। মনমোহনের বহু দিনের ইচ্ছে ছিল, প্রধানমন্ত্রিত্বকালেই এক বার পাকিস্তান যাবেন। দেশভাগের আগে উত্তর-মধ্য পাকিস্তানের ঝিলাম জেলায় তাঁর জন্ম। কিন্তু দল থেকে তাঁকে যেতে দেওয়া হয়নি।
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের জট ছাড়াতে তিনি যে আগ্রহী, সেই ইঙ্গিত গোড়াতেই দিয়ে রাখলেন মোদী। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিস্তারের যে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, তার সদ্ব্যবহার করতে চান মোদী। কারণ, ভারতের বাণিজ্য-শরিকদের মধ্যে পাকিস্তান ৪৭ নম্বরে। ভারতের বাণিজ্যের ০.৩ শতাংশ মাত্র পাকিস্তান থেকে আসে। এই পরিস্থিতিই বদলাতে চান নরেন্দ্র মোদী।