অসামান্য শ্রাবণ এখন। বৃষ্টি ধারাপাত। সোঁদা গন্ধ আমেজ। শাওন বৃষ্টিভেজা মেঘলা দুপুর বা বিকেলে বাড়িতে বসে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে জানলার শার্সির ওপারে বৃষ্টি দেখতে যতটা ভাল লাগে। মনের গতিপ্রকৃতিও কেমন টাল খেয়ে যায়। যত দূর চোখ যায়, পশ্চিমঘাট আরও নিবিড় সহজ সবুজ।
প্রকৃতির সবটুকু বিশ্বাস-ভেজা পথ, অবিরাম বৃষ্টিধারা, আরব সাগরের অতি উচ্ছ্বাস, কোথাও জমা জল, পাতে গরম ধোঁয়া ওঠা মুচমুচে ভাজা অবিকল নিয়মমাফিক। কাঠফাটা বৈশাখ জ্যৈষ্ঠের পর বৃষ্টি সবার কাছেই সমারোহের। একটা জম্পেশ করে ‘বর্ষামঙ্গল’ বা ‘ঋতুরঙ্গ’ অনুষ্ঠান এ সময়টার জন্যই যেন বরাদ্দ।
ওই দ্যাখো, বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠানের কথা লিখতে গিয়ে বহুশ্রুত একটা গল্প মনে পড়ে গেল। তাও কে, না রবীন্দ্রনাথ ও শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে নিয়ে কোথাও একটা পড়া গল্প। শ্রাবণ আসন্ন। সালটা ১৯৩৯। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান-পাগল ছাত্রটির কাছে বর্ষামঙ্গল কত দূর খোঁজ নেওয়াতে ছাত্রটির দুষ্টুমি ‘এ বারে তো বর্ষামঙ্গল হবে না। পুরনো গানে বর্ষামঙ্গল করবে না’। কবি ইঙ্গিত ধরতে পেরে কপট রাগ দেখিয়ে বলেছিলেন হাতে এত কাজ।
পরদিনই সকালে ছাত্রটিকে দিলেন নতুন গান“ওগো সাঁওতালি ছেলে’। পরদিন আরও একটি গান, “বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল।” সেই ছাত্রটি শৈলজারঞ্জন মজুমদার, কবিকে সেই ছাত্রাবস্থায় নাকি বলেছিলেন, “আমার তো মনে হয় আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় স্তম্ভটি আপনার হাতে দিলে তাতেও সুর বসাতে পারবেন।” গুরুদেব প্রিয় ছাত্রকে আরও একটি বর্ষার গান লিখে উপহার দিয়েছিলেন “সঘন গহন রাত্রি ঝরিছে শ্রাবণধারা।”
শ্রাবণের আগমনে শুধু মথুরা ব্রজধাম বা বরসানায় নয় দেশের রাধা-কৃষ্ণের মন্দির মঠে ‘ঝুলনযাত্রায়’ ভক্তদের খুশির প্রাণে আমেজ আনে। স্বামীর গৃহ থেকে কিছু দিনের জন্য পিতৃগৃহে এসেছেন রাধারানি। বৃক্ষ শাখায় ঝুলা বেঁধেছে গোপিনীরা। যমুনা তীরে কদম্ব বৃক্ষের ডালে হিন্দোল গতিসঞ্চার বাড়তে লাগল। রাইকিশোরী-গোপীবল্লভের সুখাসনে তখন এক আনন্দঘন মাত্রা।
“রাধে-শ্যাম রঙ্গেতে ঝুলে
রঙ্গেতে ঝুলে তরঙ্গেতে ঝুলে
মণিময় নব হিন্দোলা সাজাইয়া
বংশীবটতট কালিন্দী কূলে
আজও রাধা-শ্যাম রঙ্গেতে ঝুলে”
হিন্দোলে দোদুল্যমান রাধারানি। গোপিনীদের উচ্ছ্বাস আর ধরে না। এক বার তো রাধারানি তাঁর দেহবল্লরীর ভারসাম্য ধরে রাখতে না পেরে এক পাশে কাত হয়ে পড়েই যাচ্ছিলেন প্রায়। কানাইয়া চকিতে আরও নিবিড় ভাবে তাঁকে কাছে টেনে নেন।
“নবঘন কানন মোহন কুঞ্জ
বিকশিত কুসুম মধুকর গুঞ্জ...
তহি বনি অপরূপ রতন হিন্দোল
তারপর বৈঠল কিশোরী-কিশোর...
রাধার সাথে কৃষ্ণের যুগল সাজে মোহিত রূপ দেখে ব্রজবালারাও যেন আনন্দে বিলাসে পাগলপারা। এঁদের অলৌকিক সম্পর্কের মধুরতা দেখে গোপিনীরা সমবেত কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন
“ইতা নন্দন কো দুলারো
উতা ভানু কি দুলারি
জোরি লাগে অতি প্যায়ারি
ভাসি নয়ন মে”ঁ
এ সব কৃষ্ণ-রাধা লীলা লিখতে লিখতেই শ্রাবণ মাসের অনিবার্য এক দিন কলমে উঠে আসতে চাইছে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর তিয়াত্তর বছর বয়সের কথা। কথাটা সামান্য পালটিয়ে এমনও তো বলা যায়, কবিগুরুর অনন্ত জীবনের অবসান হয়েছিল আজ থেকে তিয়াত্তর বছর আগে।
“২২শে শ্রাবণ’ নামাঙ্কিত দিনটি আপামর বাঙালিকে বেদনাবিধুর করে দেয়। যদিও রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে জীবনের শেষ না ভেবে মনে করতেন, মৃত্যু জীবনেরই তুচ্ছ একটি ঘটনা মাত্র। ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থ-এ ‘মৃত্যু’ কবিতায় কবি লিখেছেন
“মৃত্যুও অজ্ঞাত মোর! আজি তার তরে ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে
জীবন আমার এত ভালবাসি বলে হয়েছে প্রত্যয়
মৃত্যুরে এমনি ভালো বাসিব নিশ্চয়।”
তাঁর মৃত্যু বহু দশক পার করে এসেছে। তবু তাঁর প্রয়াণতিথি এলে চেতনায় সঞ্চারিত হন রবীন্দ্রনাথ। মৃত্যুর মাত্র তিন বছর আগে নির্মলকুমারী মহলানবীশকে লেখা চিঠিতে কবি জানিয়েছিলেন,
“গানের পর গান লেখা চলছে এক এক দিনে চারটে পাঁচটা। যৌবনের তরঙ্গে মন দোদুল্যমান জীর্ণ শরীরটাকে কোথায় কোথায় দূরে ভাসিয়ে দিয়েছে।”
বস্তুত রবীন্দ্রনাথ জীবনভর সুস্বাস্থ্য ভোগ করলেও কিন্তু জীবনের শেষ চার বছর দীর্ঘস্থায়ী নানান অসুখবিসুখে কষ্ট ভোগ করেছেন। এক বার তো অচৈতন্য হয়ে প্রায় আশঙ্কাজনক অবস্থায় চলে গিয়েছিলেন। সেই ১৯৩৭ সাল থেকেই তাঁর দীর্ঘকালীন অসুস্থতার সূত্রপাত। ধারাবাহিক অসুস্থতা ক্রমশ তাঁর শরীরকেও অবসন্ন করে দিতে থাকে। দু’বার অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল। এর পর ১৯৪০ সালে আবারও গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পর থেকে কবি আর সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি।
‘ভানুসিংহের পদাবলীতে’ মৃত্যুকে কবি বর্ণনা করেছেন,
“মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান
মেঘবরণ তুঝ, মেঘ জটাজুট
রক্ত কমলকর, রক্ত অধরপুট তাপ বিমোচন করুন কোর তব
মৃত্যু-অমৃত করে দান
তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান”
আবার ‘মরণমিলন কবিতায়ও তাঁকে বলতে দেখি,
“অত চুপিচুপি কেন কথা কও
ওগো মরণ, হে মোর মরণ”
২২শে শ্রাবণ আসার বেশ কিছু দিন আগে থাকতেই রবীন্দ্রনাথ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর কিডনি কাজ করছিল না। নানান উপসর্গ শরীরে তখন জেঁকে বসেছে। বিশেষ সেলুনকারে শান্তিনিকেতন থেকে তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছিল। তাঁর অজ্ঞাতসারেই কিছু জটিল অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করা হচ্ছিল। সে সময়ের প্রথিতযশা চিকিৎসক তাঁর দেখভাল করছিলেন। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় স্যার নীলরতন সরকারকেও কবির কাছে আনেন। স্বনামধন্য চিকিৎসক কবির রোগশয্যার পাশে বসেছেন। কবির ডান হাতটিতে সামান্য হাত বুলিয়েছেন। এক সময় কবির ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে আরও একবার ঘুরে দেখলেন কবিকে। নীলরতন সরকারের ওই ঘুরে দাঁড়ানোটাই উপস্থিত সকলকে বুঝিয়ে দিয়েছিল রবিকবির অস্তাচলে যাওয়ার সময় সমাগত প্রায়।
জোড়াসাঁকোর বাড়িতে রোগশয্যায় শুয়ে জীবনের সর্বশেষ কবিতাটি কবি রানি চন্দকে লিখে নিতে বলেছিলেন। রানি চন্দ শ্রুতধরের মতো সে দিন লিখে নিয়েছিলেন। দিনটা ছিল চোদ্দোই শ্রাবণ। সকাল সাড়ে ন’টা। কবি আচ্ছন্ন অবস্থার মধ্যেও হঠাৎ যেন শেষবারের মতো জ্বলে উঠলেন। বলে গেলেন জীবনের শেষতম কবিতাটি। লিখে নিলেন রানি চন্দ।
“তোমার সৃষ্টির পথ
রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনাজালে,
হে ছলনাময়ী”
রবীন্দ্রনাথ, তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগ্নি, বিধবা প্রতিমাদেবীর ১৯১০ সালে বিয়ে দিয়েছিলেন। জোড়াসাঁকো পরিবারে সেই প্রথম বিধবা বিবাহ। পুত্রবধূ প্রতিমাদেবীকে অশক্ত কবি রানি চন্দকে দিয়ে চিঠি লিখিয়ে তাতে কাঁপা হস্তে সই করে দেন ‘বাবামশাই’।
২২শে শ্রাবণ দিনটি নিয়ে আরও কত কথাই লেখা আছে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক নানান বইপত্রে। এখন ২২ শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথের তিরোধান দিনটিকে স্মরণ করে ‘বৃক্ষরোপণ উৎসব’ প্রচলিত শান্তিনিকেতনে। ছেলেমেয়েরা বাসন্তী রঙের ধুতি ও শাড়ি পরে ফুলের গায়নায় সজ্জিত হয়ে কবির বৃক্ষবন্দনা গানটি গাইতে গাইতে বৃক্ষ রোপণ পর্ব যেখানে হবে, সেখানে উপস্থিত হন।
“মরুবিজয়ের কেতন ওড়াও শূন্যে
হে প্রবল প্রাণ
ধূলিরে ধন্য করো করুণার পুণ্যে
হে কোমল প্রাণ...
মাধুরী ভরিবে ফুলে ফলে পল্লবে
হে মোহন প্রাণ”
যে গাছ রোপণ করা হবে, সেটিকে চতুর্দোলায় আনা হয়। শাঁখ বাজিয়ে মাঙ্গলিক মন্ত্রোচারণ ধ্বনিতে বৃক্ষরোপণ করা হয়। এর পর আশ্রম সঙ্গীত। ২২শে শ্রাবণের পরের দিন শ্রীনিকেতনে ২৩ শ্রাবণ সকালে দুটি হালচাষের বলদকে সাজিয়ে মাঠে আনা হয়। শ্রীনিকেতনের এই ‘হলকর্ষণ উৎসব’
“গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ
আমার মন ভুলায় রে”
এবং নবগীতিকায় সংকলিত,
“ফিরে চল, ফিরে চল, ফিরে চল মাটির টানে
যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে”
উপরিউক্ত দুটি গান গেয়ে, কিছু অংশ জমি চাষ করা হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিশিষ্ট অতিথি হাল ধরেন। অন্যান্যরা তাঁকে সাহায্য করেন। ‘হলকর্ষণ উৎসব’ এ ভাবে অনুষ্ঠিত হয়। কবির তিরোধান দিনটি উপলক্ষ করে ভারত সরকার ১৯৫০ সাল থেকে কবির প্রচলিত এই বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানটি পালন করে চলেছে সারা দেশ জুড়ে।
সংস্কৃতিপ্রেমী বাঙালির কাছে শ্রাবণের বাইশতম দিনটি যথেষ্ট মর্যাদা ও বিষাদে পালিত দিন। রবিঠাকুরকে সামনে রেখেই আমাদের ঝালিয়ে নেওয়া বাঙালিত্ব তথা সংস্কৃতিমনস্কতাও। তিনি যে আজও আমাদের কাছে তাঁর সংস্কৃতি-সাহিত্য-কাব্য-শিল্পকলা-গান-কবিতা সমস্ত কিছুর ভেতর দিয়ে ভীষণ রকম প্রাসঙ্গিক। তাঁর ‘সার্ধশতবছর জন্মতিথি’, ‘গীতাঞ্জলির একশো বছর’ ইত্যাদি সমস্ত কিছু পেরিয়েও আজও আমাদের কাছে ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’।
রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণতিথি নিয়ে এ পর্যন্ত লেখার পরই ক্যালেন্ডারে এক ঝলক চোখ পড়তেই দেখি সামনেই ১০ অগস্ট রবিবার রাখি পূর্ণিমা। কৃষিনির্ভর ভারতে রাখি পূর্ণিমার দিনটি, শ্রাবণী পূর্ণিমা তিথির বিশেষ দিনটিকে ‘গো পূর্ণিমা’ বা কোনও কোনও বিশেষ অঞ্চলে ‘ঘামা পূর্ণিমা’ বলা হয়। কৃষিকাজে হাল, বলদ ইত্যাদির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। গবাদি পশুর মাধ্যমে মৃত্তিকা ভূমিতে কর্ষণ করিয়ে তারপর সেই ঊর্বর জমিতে শস্য রোপণ করা হয়। সে জন্যই লাঙল বা হালকে পুজো দেওয়ার রীতি প্রচলিত। আবার গো-বলয়ের গ্রামীণ অঞ্চলগুলিতে দিনটি ‘বলরাম জয়ন্তী’ বা ‘দাউ পূণিমা’ বলা হয়। বলরামের মূর্তির হাতে ধরা থাকে মৃত্তিকা কর্ষণের প্রধান অস্ত্র লাঙল বা হাল।
এই দিনটিতে কৃষি জীবিকা-নির্ভর গৃহস্থ পরিবারে ঘরদোর সাফসুতরো করে, কোনও নির্দিষ্ট দেওয়ালে সাদা প্রলেপ দিয়ে সেখানে কৃষি যন্ত্রপাতি, লাঙল, গরুর গাড়ি, মহিষ বা গরুর ছবির আলপনা আঁকা হয়। বাড়ির গৃহপালিত পশুকে যত্ন করে স্নান করিয়ে পিঠে নতুন বস্ত্র চাপিয়ে দেওয়া হয়। গবাদি পশুর মাথায় হলুদ-কুমকুম-চন্দনের পবিত্র তিলক এঁকে দেওয়া হয়। গবাদি পশুর শিং দুটিকেও তেল মালিশ করে চকচকে করে কখনও বা রঙিন কারুকাজও করা হয়। গরুর গাড়িকেও ফুলের মালা কাগজের কারুকাজ দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়। গবাদি পশুকে চালের তৈরি পিঠে খেতে দেওয়ার রীতি আছে। সমস্ত রকম কৃষি যন্ত্রপাতি ও গবাদি পশুকে পুজো দেওয়া হয়ে গেলে অপরাহ্ণে স্থানীয় ময়দানে নিয়ে গিয়ে নানান কুচকাওয়াজ প্রদর্শনেরও রীতি রেওয়াজ আছে।
হিন্দু সমাজে ভাইবোনের মধুর সম্পর্ক বোঝাতে রাখি উৎসব বা রক্ষাবন্ধন উৎসব পালিত হয়।
“ইয়ে রাখি বন্ধন হ্যায় অ্যায়সা
যেইসে চন্দা অওর কিরণ কা
যেইসা বদরি অওর পবন কা
যেইসা ধরতি অওর গগন কা...”
রাখি মূলত প্রীতি বন্ধনের উৎসব। হিন্দু পঞ্জিকা মতে শ্রাবণী পূর্ণিমার দিন ভাইয়ের সুমঙ্গল কামনায় বোন তার ডান হাতে বেঁধে দেয় পবিত্র রাখি। ভাইও প্রতিশ্রুত থাকে আজীবন বোনকে সুখ শান্তি তথা রক্ষা করার। পবিত্র মধুর সম্পর্ক সূত্র রাখি নিয়ে পুরাণ-মহাভারত-ইতিহাসে কত যে আখ্যান আছে। পুরাণে আছে যম-এর মঙ্গল কামনায় বোন যমি রাখি বেঁধে দেন এবং প্রীত যম বোনকে আশীর্বাদ করেন এবং সারাজীবন রক্ষা করার শপথ নেন। মহাভারতে আছে বাসুদেব কৃষ্ণ এক বার সামান্য আহত হয়ে তার ডান হাতের কবজি থেকে রক্তপাত শুরু হওয়াতে যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদী নিজের আঁচল ছিঁড়ে কৃষ্ণের কবজিতে বেঁধে দেন। পুলকিত কৃষ্ণ সখি কৃষ্ণাকে বলেন উচিত সময় তিনিও এর প্রতিদান দেবেন। এর বহু বছর পর কূটকৌশলে পাশা খেলায় হেরে যাওয়ার পর, যৌতুক হিসাবে পণ রাখা দ্রৌপদীকে রাজসভায় বস্ত্রহরণের সময় কৃষ্ণ সম্মান রক্ষা করেন।
“বহেনা নে ভাই কী কলাই সে
প্যায়ার বাঁন্ধা হ্যায়
প্যায়ার কে দো তার সে
সংসার বাঁন্ধা হ্যায়
রেশম কী ডোরি সে
সংসার বাঁন্ধা হ্যায়”
রাখি উৎসবকে কেন্দ্র করে মধুর সম্পর্ক ঘিরে নানান আখ্যান কথকতা ছড়িয়ে আছে। আবারও সেই আমাদের ঘরের কবিকে, রবিঠাকুরকে উল্লেখ করি। যিনি রাখি উৎসবকে কেবলমাত্র ভাই-বোনের সম্পর্কে আবদ্ধে না রেখে সৌভ্রাতৃত্বের উৎসব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। রাখিকে রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র হিন্দুদের উৎসব না ভেবে, একে সামাজিক তথা বিশ্ব মানবতার উৎসব হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। যেখানে জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি ব্যক্তি একে অপরকে রক্ষা করবে। মনে রাখতে হবে, তখন কিন্তু ব্রিটিশ শাসন ও অরাজকতা কায়েম এদেশে। হিন্দু মুসলমান জোট শক্তিকে রাখি বন্ধনের মাধ্যমে একত্র হয়ে বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিহত করতে উৎসাহী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
একটি মাত্র অমোঘ রেশম সুতোর বাঁধনকে সম্পর্কের চিরকালীন রক্ষাকবচ হিসেবে ভাইবোনের সুন্দর উৎসবটি রেশ রেখে যায়
“ভাইয়া মোরে,
রাখি কে বন্ধন কো নিভানা
ভাইয়া মোরে,
ছোটি বহন কো না ভুলনা
দেখো ইয়ে নাতা না নিভানা”
সবশেষে একটু ছুঁয়ে যাই আগামী স্বাধীনতা দিবসের দিনটির কথা। নেহরু, গাঁধীজি, মৌলানা আজাদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ জাতীয় আন্দোলন যখন প্রথম শুরু করেন, তাঁরা কিন্তু তখনও আঁচ করতে পারেননি যে একদিন দ্বি-খণ্ডিত ভারতের স্বাধীনতাকেই মানতে হবে। সুভাষচন্দ্র বারবার বলেছেন, আপসহীন চূড়ান্ত এবং নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের কথা। বৈঠকী রাজনীতিকে প্রাধান্য দিলে সরকার যে দেশকে ভাগ করে দিয়ে যাবে সে কথা তখন কেউ ধর্তব্যেই আনেননি। বস্তুত শেষ ইংরেজ বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতে এসেই বুঝে গেছিলেন ভারতকে অখণ্ড রাখা যাবে না কোনও মতেই। জিন্নার জেদের কাছে হার মানতে হয়েছে সব তাবড় কংগ্রেসি নেতাদের। এসেছিল দ্বি-খণ্ডিত স্বাধীনতা।
ইতিহাস উহ্য রেখে, পাঠক আসুন আমরা আরও খানিকসময় উৎসব আনন্দ শ্রাবণধারায় জারিত হয়ে থাকি।