শিয়রে দাউদ, তাই কি ‘গ্রেফতার’ রাজন

সিনেমার সংলাপকে বাস্তবেও সত্যি করে দেখিয়েছিলেন ছোটা রাজন। ‘ডন কো পকড়না মুশকিল হি নহি, নামুমকিন হ্যায়!’ কিন্তু কার সাহায্যে? সেই বন্ধু কি ‘র’ বা আইবি?

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৪৮
Share:

সিনেমার সংলাপকে বাস্তবেও সত্যি করে দেখিয়েছিলেন ছোটা রাজন। ‘ডন কো পকড়না মুশকিল হি নহি, নামুমকিন হ্যায়!’ কিন্তু কার সাহায্যে? সেই বন্ধু কি ‘র’ বা আইবি?

Advertisement

তলপেটে বড় ব্যান্ডেজ, হাতে লাগানো স্যালাইনের ড্রিপ, শ্বাসকষ্ট হলে দিতে হচ্ছে অক্সিজেন মাস্ক। ব্যাঙ্ককের সুখুমভিটে সামিতিভেজ হাসপাতালে শুয়ে ছোটা রাজন। মাস দুয়েক আগেই সুখুমভিট সয়-এর চারন কোর্টে তাঁর ফ্ল্যাটে ঢুকে হামলা চালায় দাউদ ইব্রাহিমের দল। দাউদের একদা অনুচর, পরে চরম শত্রু হওয়া রাজন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও তাঁর তলপেটে গুলি লাগে। অস্ত্রোপচার হয় হাসপাতালে। কিন্তু মুম্বই পুলিশের দল তাঁকে ধরতে আসছে খবর পেয়ে ওই অবস্থাতেও পালিয়ে যান ছোটা রাজন। সেটা ২০০০-এর ২৪ নভেম্বর।

সেই ছোটা রাজন ইন্দোনেশিয়ার বালিতে গ্রেফতার হওয়ার দু’দিন পর, মঙ্গলবার স্মৃতিচারণ করছিলেন ধনুষ্যকোডি শিবানন্দন— মুম্বইয়ের প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার। মহারাষ্ট্র পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল পদ থেকে অবসর নেন ২০১১-এ।

Advertisement

এ দিন শিবানন্দন টেলিফোনে আনন্দবাজারকে বললেন, ‘‘সব কাজ ঠিকঠাক এগোচ্ছিল। দাউদের দলের হামলায় গুলি খেয়ে ব্যাঙ্ককের হাসপাতালে ভর্তি ছোটা রাজনকে মুম্বইয়ে নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করছিলাম। এ কাজ করতে গেলে ভারতীয় দূতাবাস মারফত বিদেশ মন্ত্রকের চিঠি যাওয়ার কথা তাইল্যান্ডের প্রশাসনের কাছে। কিন্তু খবর এল, ছোটা রাজন হাসপাতাল থেকে পালিয়ে গিয়েছে। অথচ ও কিন্তু তখন তাইল্যান্ড পুলিশের হেফাজতেই ছিল!’’

সেই সময়ে মুম্বই পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের যুগ্ম কমিশনার শিবানন্দনের সংযোজন, ‘‘মনে হয় আরও অনেক বড় প্রভাবশালী কেউ চায়নি, ছোটা রাজন আমাদের হাতে আসুক।’’

সেই প্রভাবশালী কে? ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা ‘র’? নাকি ভারতের কোনও গোয়েন্দা সংস্থা? শিবানন্দনের বক্তব্য, ‘‘আমার জানা নেই। এটা বরং ওঁদেরই জিজ্ঞেস করুন।’’

প্রথমে ভাবা হয়েছিল, কোনও পেশাদার পর্বতারোহী দড়ি বেয়ে উঠে আবার ছোটা রাজনকে নিয়ে দড়ি বেয়ে নেমে গিয়েছেন। কিন্তু তাই পুলিশ বুঝতে পারছিল না, ভারী চেহারার, অসুস্থ ওই ডনকে নিয়ে কী ভাবে কোনও পেশাদার পর্বতারোহীর পক্ষেও ওই ভাবে নামা সম্ভব?

ওই ঘটনার এক যুগ পর রাজনের শাগরেদ সন্তোষ শেট্টি ধরা পড়লে তাঁর কাছ থেকে সত্যিটা বেরোয়। মুম্বই পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চকে দেওয়া জবানবন্দিতে সন্তোষ জানান, তাই সেনার একাংশই রাজনকে পালাতে সাহায্য করেছিল। প্রথমে হাসপাতালে প্রহরারত তাই পুলিশদের পানীয়ে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে তাঁদের বেহুঁশ করা হয়। তার পর তাই সেনাবাহিনীর একটি গাড়িতে তোলা হয় রাজনকে। ভারতীয় ডনকে নিয়ে সেনার ওই দলটি পৌঁছয় কম্বোডিয়া সীমান্তে। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন কম্বোডিয়ার এক গভর্নর। তিনি ছোটা রাজনকে একটি হেলিকপ্টারে তুলে পৌঁছে দেন সিয়েম রিপ টাউনের নিরাপদ আশ্রয়ে।

মুম্বই পুলিশের এক অফিসারের কথায়, ‘‘শুধু তাই পুলিশ জড়িত হলে বুঝতাম রাজনই ঘুষ দিয়ে পালিয়েছে। কিন্তু তাই সেনাবাহিনী যখন এই কাজ করেছে, তখন ‘র’ বা আইবি-র হাত থাকাটা একেবারেই অস্বাভাবিক নয়!’’

এমনকী, মুম্বই পুলিশের একটি সূত্রের দাবি— ছোটা রাজনের সঙ্গে ভারত সরকারের কয়েক জন পদস্থ কর্তার বোঝাপড়ারই ফসল এই গ্রেফতার। ওই সূত্রটির দাবি, বুধবারই ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপের বিমানবন্দরে নামা মাত্র রাজনকে ধরা হয়েছিল। কিন্তু সব ঠিকঠাক হওয়ার পরেই রবিবার তাঁকে সরকারি ভাবে গ্রেফতার দেখানো হয়।

মুম্বই ক্রাইম ব্রাঞ্চের এক পোড় খাওয়া অফিসারের বক্তব্য, গত সপ্তাহেই ভারতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বিজয়কুমার সিংহ ইন্দোনেশিয়ার বিদেশমন্ত্রী রেতনো এলপি মারসুদির সঙ্গে দেখা করেন। দু’জনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার বিষয়ে কথা হয়। গত এপ্রিলে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজও ইন্দোনেশিয়া যান। এর পরে নভেম্বরের গোড়াতেই উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারির সে দেশে যাওয়ার কথা। ওই পুলিশ কর্তার দাবি— এই সব সফর-বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল ছোটা রাজনকে ইন্দোনেশিয়া থেকে ভারতে আনার রাস্তা পরিষ্কার করা। মুম্বই পুলিশের অফিসারদের বড় অংশ মনে করছেন, বালি দ্বীপে তাঁর এই ভাবে গ্রেফতার হওয়াটা ছোটা রাজন নিজেই ভারত সরকারের কয়েক জন পদস্থ অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঠিক করেছিলেন।

কিন্তু এতে ছোটা রাজনের কী স্বার্থ? মুম্বই পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ সূত্রের খবর, এমনিতেই ছোটা রাজন অসুস্থ। কিডনির সমস্যায় ভুগছেন। এতটাই যে, নিয়মিত ডায়ালিসিস করতে হয়। ১৫ বছর আগে তলপেটে ‘ডি কোম্পানি’-র পুরে দেওয়া গুলির ক্ষতও পুরোপুরি সারেনি। তবে মুম্বই পুলিশের অনেকেরই মতে, ছোটা রাজন তার চেয়েও বেশি ভীত প্রাণভয়ে। তাঁর সব সময়েই মনে হয়, এই বুঝি দাউদের দল তাঁকে খুন করতে আসছে। রাজনের বিশ্বস্ত অনুচরদের মধ্যে সন্তোষ শেট্টি, অনিল চন্দ্র, বান্টি পাণ্ডেকে বিদেশ থেকে ভারতে আনা হয়েছে। সেই অর্থে ছোটা রাজন কিন্তু বিদেশে একা হয়ে পড়েছিলেন। অথচ দাউদের সেনাপতি ছোটা শাকিল রাজনকে হত্যা করার জন্য বদ্ধপরিকর। এ বছর জুলাইয়েও ছোটা শাকিল অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে ছোটা রাজনকে খুনের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শাকিলের মোবাইলে আড়ি পেতে সে কথা জেনে ভারতীয় গোয়েন্দাদের একাংশই রাজনকে সতর্ক করে দেন।

এই ছোটা শাকিলের নেতৃত্বেই ২০০০ সালে ব্যাঙ্ককে ছোটা রাজনের ফ্ল্যাটে ঢুকে হামলা চালায় ডি কোম্পানি। ছোটা রাজন গ্রেফতার হওয়ার পর ছোটা শাকিল একটি ইংরেজি দৈনিককে বলেছে, ‘‘আমরা, মানে ডি কোম্পানি ছোটা রাজনের গ্রেফতারির খবরে খুশি হতে পারছি না। ওকে খতম করতে চাই। যত ক্ষণ না পারছি, আমার বিশ্রাম নেই।’’

ডি কোম্পানির চেষ্টার সামনে ছোটা রাজনের অবস্থা নখদন্তহীন, অসুস্থ বাঘের মতো হয়েছিল বলে মুম্বই পুলিশের একাংশ মনে করেন। মুম্বইয়ের প্রাক্তন সিপি মহেশনারায়ণ সিংহ আনন্দবাজারকে বললেন, ‘‘এখন আর ছোটা রাজনের সেই ঝাঁঝ নেই। ২০০০ সালে ধরতে পারলে লাভ হতো। অনেক খুন, গ্যাং-ওয়ার ঠেকানো যেত।’’ মুম্বইয়ের আর এক প্রাক্তন সিপি শিবানন্দন বলেন, ‘‘২০১১-র জুনে সাংবাদিক জে (জ্যোতির্ময়) দে-র খুনের পর ছোটা রাজনের নাম কিন্তু আর কোনও অপরাধে সে ভাবে উঠে আসেনি। ওর আর ক্ষমতা ছিল না।’’ এক গোয়েন্দা অফিসার বলেন, ‘‘ছোটা রাজন কিন্তু বুঝতে পারছিল, শাকিল যে কোনও সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় ওর হদিস পেয়ে যাবে। সেই জন্য অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন জায়গায় সে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল।’’

কোণঠাসা ছোটা রাজনের ‘ইচ্ছাকৃত গ্রেফতার হওয়ার’ ক্ষেত্রে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল বড় ভূমিকা নিয়েছেন বলে গোয়েন্দাদের একাংশ দাবি করছেন। তাঁরা মনে করাচ্ছেন, শোনা যায় আইবি-র প্রাক্তন অধিকর্তা ডোভালের গাড়ি থেকেই বছর দশেক আগে দিল্লিতে রাজনের ডান হাত ভিকি মলহোত্রকে গ্রেফতার করেছিল মুম্বই পুলিশ। যদিও ডোভাল তা অস্বীকার করেন। ভিকি ও ফরিদ তানাশা নামে দুই বন্দুকবাজকে দিয়ে দাউদ ইব্রাহিমকে হত্যার ছক কষেছিল রাজন। ঠিক ছিল, দুবাইয়ের একটি পাঁচতারা হোটেলে দাউদ ইব্রাহিমের মেয়ের সঙ্গে প্রাক্তন পাক ক্রিকেটার জাভেদ মিয়াঁদাদের ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানেই খতম করা হবে দাউদকে। কিন্তু ভিকি ও ফরিদ— দু’জনকেই মুম্বই পুলিশ গ্রেফতার করায় সেই পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যায়। গোয়েন্দাদের অনেকেরই দাবি, দাউদকে ওই ভাবে হত্যার পরিকল্পনা আসলে করেছিল ‘র’ এবং আইবি-ই।

মুম্বই পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের কর্তাদের একাংশের বক্তব্য— যাঁরা দাউদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য দু’দশক ছোটা রাজনকে আগলে রেখেছেন, তাঁদের উদ্যোগেই ছোটা রাজন গ্রেফতার হল, সেটা দাউদের হাত থেকে তাঁকে আগলে রাখতেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন