সংস্কারের পথেই সেরা ভারত, প্রণবের বক্তৃতায় বার্তা মোদীর

আগামী দিনগুলিতে কোন পথে এগোবে তাঁর সরকার, আজ রাষ্ট্রপতির অভিভাষণের মাধ্যমে এই প্রথম তা নথি আকারে পেশ করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মন্ত্রক ধরে ধরে মোদী বলে দিলেন, ভোট প্রচারে তিনি যে নতুন ভারতের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, কী ভাবে তার রূপায়ণ করতে চাইছেন তিনি। রাষ্ট্রপতির মুখ দিয়েই বলিয়ে দিলেন নিজের তিনটি স্লোগান, ‘সর্বনিম্ন সরকার, সর্বোচ্চ প্রশাসন’, ‘এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত’ ও ‘সকলের সহযোগ, সকলের বিকাশ’। এর মাধ্যমেই মোদী তুলে ধরলেন একটি ব্র্যান্ড-ভারতের রূপরেখা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৪ ০৩:২৯
Share:

রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে স্বাগত জানাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী। সোমবার সংসদ ভবনে। ছবি: পিটিআই

আগামী দিনগুলিতে কোন পথে এগোবে তাঁর সরকার, আজ রাষ্ট্রপতির অভিভাষণের মাধ্যমে এই প্রথম তা নথি আকারে পেশ করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

Advertisement

মন্ত্রক ধরে ধরে মোদী বলে দিলেন, ভোট প্রচারে তিনি যে নতুন ভারতের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, কী ভাবে তার রূপায়ণ করতে চাইছেন তিনি। রাষ্ট্রপতির মুখ দিয়েই বলিয়ে দিলেন নিজের তিনটি স্লোগান, ‘সর্বনিম্ন সরকার, সর্বোচ্চ প্রশাসন’, ‘এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত’ ও ‘সকলের সহযোগ, সকলের বিকাশ’। এর মাধ্যমেই মোদী তুলে ধরলেন একটি ব্র্যান্ড-ভারতের রূপরেখা।

কী ভাবে তুলে ধরলেন এই নতুন ভারতের ভাবনাকে?

Advertisement

সংসদের সেন্ট্রাল হলে সনিয়া গাঁধী ও মনমোহন সিংহের উপস্থিতিতেই মোদী স্পষ্ট করে দিলেন, ইউপিএ জমানার মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি, নীতিপঙ্গুত্ব দূর করে অর্থনীতির মোড় ঘোরানোই তাঁর লক্ষ্য। গরিবদের মান উন্নয়ন করা যেমন তাঁর অগ্রাধিকার, তেমনই স্বচ্ছ প্রশাসনের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোও তাঁর বড় চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘদিন ধরে লালিত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে তুলে দিয়ে একটি দক্ষিণপন্থী খোলা বাজারের অভিমুখই তিনি গ্রহণ করতে চলেছেন, রাষ্ট্রপতির বক্তৃতায় স্পষ্ট রইল সেটিও। বিশেষ করে ইউপিএ জমানায় যে ভাবে সামাজিক ক্ষেত্রকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, কথায় কথায় আইন করে বিভিন্ন অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছিল, সে পথে হাঁটবেন না মোদী। বরং মানুষকে স্বাবলম্বী করে তাঁদের নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে রোজগার বাড়ানোর উপরেই জোর দিতে চান।

তবে এই যাত্রাপথের সূচনা যে আদৌ মসৃণ নয়, সে কথাও কবুল করেছেন মোদী। রাষ্ট্রপতির বক্তৃতায় উঠে এসেছে, লাগাতার দু’বছর বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের নীচে থাকার কথা। কমেছে কর সংগ্রহ। হতাশায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন লগ্নিকারীরাও। তার উপর কৃষি ক্ষেত্রকে তিনি অভিনব নানা পথে লাভজনক করে তুলতে চাইলেও আশঙ্কা রয়েছে অনাবৃষ্টিরও। এই অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে বিকল্প প্রস্তুতির পাশাপাশি সরকারি তন্ত্রের খোলনলচেও বদলে ফেলতে চাইছেন মোদী। ইউপিএ জমানায় সনিয়া গাঁধী ও মনমোহন সিংহের দ্বৈত ক্ষমতাকেন্দ্রের জন্য প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক কর্তৃত্বের যে অভাব ছিল, এ বারে একদলীয় জনমতের জন্য সেই সমস্যা থাকার কোনও কথাও নয়। এই বিপুল জনমতের জোরেই জয়ললিতার আপত্তি সত্ত্বেও যেমন তিনি শপথের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টকে, সরকারের যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ও তাঁর প্রয়োজন নেই কাউকে পরোয়া করার। মন্ত্রিগোষ্ঠী বিলোপের মাধ্যমেই মোদী বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর জমানায় সিদ্ধান্ত হবে চটজলদি। আমলাদেরও দেওয়া হচ্ছে ঢের বেশি স্বাধীনতা, যাতে তাঁদের মনোবল বাড়ে। সরকারের কাজ হবে সব বিষয়ে স্বচ্ছ নীতি রূপায়ণ করা। যাতে সরকারের উপরেও সকলের আস্থা থাকে। মানুষ অনেক বেশি অংশীদার হয়ে ওঠে সরকারের কর্মযজ্ঞে।

আর এই দর্শনের উপরে দাঁড়িয়েই আজ মোদী রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার মাধ্যমে ঘোষণা করলেন কিছু স্বল্প ও কিছু দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প। পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিপুল জোয়ার এনে দেশি-বিদেশি লগ্নিকারীদের জন্য বিশাল বাজার খুলে দিলেন। পুরনো অকেজো আইন বাতিল করে প্রশাসনিক জটিলতা ও কর কাঠামোয় সরলীকরণের পথনির্দেশিকাও পেশ করলেন। প্রথমেই জোর দিলেন গ্রামীণ উন্নয়নে। কিন্তু সেখানেও বুঝিয়ে দিলেন, গ্রাম ও শহরের মধ্যে কোনও বিভেদ নেই। নতুন শহর নির্মাণের পাশাপাশি গ্রামেও পৌঁছে দেবেন শহরের সুবিধা। গ্রামে-গ্রামে পৌঁছে দিতে চাইছেন ইন্টারনেটের সুবিধা। ভোট প্রচারে সব বাড়ি পাকা করে সেখানে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ, পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। মোদী আজ স্পষ্ট করলেন, পাঁচ বছরে নয়, এই প্রকল্প রূপায়ণ করতে লেগে যাবে আরও আট বছর। মোদী এটাও বোঝালেন যে, জনমত পাঁচ বছরের হলেও লম্বা ইনিংস খেলতেই মাঠে নেমেছেন তিনি। ফলে আগামী পাঁচ বছর এমন কাজই তিনি করতে চান, যাতে পরের পাঁচ বছরেও ভিতও তৈরি হয়ে থাকে।

বিরোধী পক্ষে থাকার সময় বরাবরই বিজেপি অভিযোগ তুলে এসেছে, কংগ্রেস সংখ্যালঘুদের তোষণ করে আসছে। কিন্তু মোদীর দর্শন ছিল, সকলের জন্য উন্নয়ন। গুজরাতেও তিনি উন্নয়নে শরিক করেছেন সকলকে। এ বারে প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেও সেই কথাই রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে বললেন তিনি। মাদ্রাসার আধুনিকীকরণের কথা বললেও সংখ্যালঘুদের সমান সুযোগ দেওয়ার কথা বলে তিনি চেনা ছন্দেই হাঁটলেন। একই পথ ধরলেন তফসিলি জাতি-উপজাতি ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণির ক্ষেত্রেও। সব ধর্মের তীর্থস্থলকে সমান গুরুত্ব দেওয়া, নতুন ৫০টি পর্যটন সার্কিট চালুর কাজকেও মিশন হিসেবে দেখার কথা জানালেন মোদী।

প্রধানমন্ত্রী আজ স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি যেমন ব্যবসা-বান্ধব হবেন, তেমনই যাঁদের ভোটে তিনি জিতে এসেছেন, তাঁদের আশা ও স্বপ্ন পূরণও তাঁর অগ্রাধিকার হবে। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় বক্তৃতায় জানিয়েছেন, তাঁর সরকার গরিবদের জন্য দায়বদ্ধ। গরিবের কোনও ধর্ম হয় না, খিদের কোনও জাত হয় না, হতাশার কোনও ভূগোল হয় না। দারিদ্রের অভিশাপ থেকে মুক্তি দেওয়া এই সরকারের লক্ষ্য। এবং এমন নীতিতে বিশ্বাসী একটি দলকে ত্রিশ বছর পর জাত-পাত-ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে সরকারে বসিয়েছে জনতা। আশার এই নির্বাচন ভারতের গণতন্ত্রেও এক নতুন মোড়।

ভোট প্রচারেই আশার সঞ্চার করেছিলেন। এখন সরকারে এসে মোদী দিলেন নির্দিষ্ট রূপরেখা। মন্ত্রক ধরে ধরে। বলে দিলেন, মূল্যবৃদ্ধি রুখতে সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক করা হবে। যে প্রস্তাব তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় মনমোহনকে দিয়েছিলেন। গণবন্টন ব্যবস্থা ঢেলে সাজার সঙ্গে বন্ধ করা হবে কালোবাজারি, মজুতদারি। কৃষি পরিকাঠামোয় সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে লাভজনক করে তোলা হবে কৃষি ক্ষেত্রকে। একটি নতুন জমি ব্যবহার নীতি রূপায়ণ করা হবে, যার মাধ্যমে চাষের অযোগ্য জমি চিহ্নিত করে উৎপাদন বাড়ানো হবে। গুজরাতে সফল পরীক্ষার পর এক-এক জলবিন্দুর প্রয়োগ করে সেচ ব্যবস্থাকেও ঢেলে সাজা হবে।

যুবকদের হাতের কাজ, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে সরকার। এমপ্লয়েন্টমেন্ট এক্সচেঞ্জের নাম বদলে করা হচ্ছে কেরিয়ার সেন্টার। ভুরি-ভুরি অনলাইন কোর্সে গুণমান যাতে হারিয়ে না যায়, তার জন্য চেষ্টা করা হবে। সব রাজ্যে গড়া হবে আইআইটি, আইআইএম, এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল। জাতীয় ক্রীড়া প্রতিভা সন্ধানের জন্য একটি নতুন নীতি রূপায়ণ করে গ্রাম থেকে যোগ্য ব্যক্তিদের তুলে আনা হবে। নেওয়া হবে নতুন একটি স্বাস্থ্য নীতি।

জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় যে মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ করাতে পারেনি ইউপিএ সরকার, এ বারে তা পাশ করানোর ব্যাপারে দায়বদ্ধতাও প্রকাশ করলেন মোদী। উৎপাদন শিল্পকে চাঙ্গা করতে শ্রম-ভিত্তিক শিল্পে জোর দেওয়া হবে। পাশাপাশি পেনশন ও স্বাস্থ্য বিমাও দেওয়া হবে শ্রমিকদের। ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডর ও শিল্প করিডরের পাশে বিশ্ব মানের বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে কেন্দ্র ও রাজ্যের এক-জানলা পদ্ধতিও চালু করতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী। রফতানিতে উৎসাহ দেওয়া, হাই-স্পিড ট্রেনের চতুর্ভুজ সংযোগ, কৃষি-রেল নেটওয়ার্ক, নতুন বন্দর, বন্দরের সঙ্গে রেল-সড়ক যোগাযোগ গড়াও রয়েছে সরকারের কাজের তালিকায়।

মোদীর এই ব্র্যান্ড ভারত সম্পর্কে এখনই নেতিবাচক কোনও মন্তব্য করার অবস্থায় নেই কংগ্রেস। তাদের নেতা আনন্দ শর্মা এ দিন বলেছেন, “সংসদে মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ ও পরমাণু চুক্তি কার্যকর করার ঘোষণাকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। আর বাকি বিষয়গুলি সম্পর্কে এটাই বলার যে, কাজগুলি কিন্তু করে দেখাতে হবে।”

মোদীর বিশ্বাস, তিনি পারবেন। রাষ্ট্রপতির বক্তৃতায় আজ সেই বিশ্বাসটাই তুলে ধরলেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন