নিউ মার্কেট থানার অ্যালবামে এঁদের অনেকেরই ছবি-সহ পরিচয় রয়েছে। কারও নাম ‘জাপানি শাহিদ’, কেউ ‘স্প্যানিশ রাজু’, কেউ বা ‘জার্মান সাহেব’।
এঁরা নিখাদ ভারতীয়। নামের আগে বিদেশি ভাষার নাম জুড়েছে সেই ভাষায় দক্ষতার সুবাদে। ওঁরা সদর স্ট্রিটের গাইড। বিদেশি ভাষায় প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নেই অনেকেরই। কিন্তু কাজের তাগিদে জাপানি বা স্প্যানিশ বলতে তাঁরা এতটাই সড়গড় যে, কলকাতায় এসে ওঁদের উপরেই ভরসা করেন অধিকাংশ বিদেশি।
এই গাইডদের ব্যবসার পরিধি সদর স্ট্রিট ছাড়িয়ে পৌঁছেছে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, মার্কুইস স্ট্রিটে। দিনভর বিভিন্ন হোটেলের সামনে আড্ডা আর বিদেশি দেখলে যেচে ভাব জমানো। পুলিশ অবশ্য বলছে, এই গাইডদের মধ্যে মিশে যাচ্ছে বহু প্রতারক-দুষ্কৃতীও। যার সর্বশেষ উদাহরণ ‘জাপানি শাহিদ’। কলকাতায় বেড়াতে আসা এক জাপানি তরুণীকে গণধর্ষণের অভিযোগে জাপানি শাহিদ-সহ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে লালবাজার। শাহিদ যৌন নিগ্রহের ঘটনায় ২০০৪ সালে বেনিয়াপুকুর ও ২০১১ সালে কড়েয়া থানায় গ্রেফতার হয়েছিল।
কী ভাবে চলে এই চক্র?
সদর স্ট্রিটের বিভিন্ন হোটেলের সামনেই আড্ডা জমায় বিভিন্ন দুষ্কর্ম চক্রের সদস্যেরা। কোন হোটেলে কে ঢুকছে-বেরোচ্ছে, তার উপরে নজর রাখে তারা। হোটেল থেকেও পর্যটকদের তথ্য চলে যায়। শাহিদও এমনই একটি চক্র চালাত বলে পুলিশ সূত্রের খবর। নির্দিষ্ট ভাষার বিদেশি পেলেই প্রতারক-গাইডেরা বুঝে নিতে চায়, পর্যটক শহরে নতুন কি না। তা হলেই পরিচিত দোকানে নিয়ে যায় পর্যটককে। দোকানদারের সঙ্গে সাঁট করে তাঁকে ঠকায়। কখনও পরিচিত গাড়িতে উঠিয়ে সামান্য পথ যেতেও কয়েক হাজার টাকা নিয়ে নেয়। পুলিশের একাংশের বক্তব্য, মাদকাসক্ত পর্যটকেরা গাইডদের থেকেই হেরোইন বা চরস জোগাড় করেন।
লালবাজারের একটি সূত্র বলছে, লোক ঠকিয়ে গাইডদের আয়ও কম নয়। শাহিদের ডেরা খুঁজতে গিয়েও চোখ কপালে উঠেছিল গোয়েন্দাদের। স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে নিয়ে পার্ক সার্কাসের চার নম্বর ব্রিজের কাছে একটি হোটেলে থাকত শাহিদ। হোটেলের এক দিনের ভাড়া ১৬০০ টাকা। আরও সব খরচ মিলিয়ে মাস গেলে হোটেলে ৭০-৮০ হাজার টাকা বিল মেটাত শাহিদ।
লোক ঠকানোর নির্দিষ্ট পন্থাও আছে গাইডদের। যেমন, জাপানি পর্যটক এলেই প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় দিঘায়। সেখান থেকে বুদ্ধগয়া। কখনও কখনও বুদ্ধগয়া থেকে বারাণসী। ওই জাপানি তরুণীকেও প্রথমে দিঘা এবং পরে বুদ্ধগয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে যাওয়ার পরে জাভেদ নামে আর এক অভিযুক্তের পৈতৃক বাড়িতে রাখা হয়েছিল। সেখানেই দু’সপ্তাহ আটকে রেখে ধর্ষণ ও মারধর করা হয় তাঁকে। কেড়ে নেওয়া হয় এটিএম কার্ড ও পিন। তদন্তে নেমে পুলিশ জেনেছে, এটিএম কার্ড ব্যবহার করে তিনটি আলাদা এটিএম থেকে টাকা তুলেছিল শাহিদরা। জাপানি তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগের তদন্তে আরও কিছুটা এগিয়েছে পুলিশ। শনিবার জাভেদ খান ও সাজিদ খান নামে দুই ধৃতকে ব্যাঙ্কশাল আদালতে হাজির করা হয়। পাঁচ জন ধৃতকেই অভিযোগকারিণীকে দিয়ে শনাক্তকরণ প্যারেড করানোর নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
জাপানি তরুণীকে সাবিরের গাড়ি চাপিয়ে বুদ্ধগয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে তরুণীর সঙ্গে চালককেও আটকে রেখেছিল জাভেদ। গাড়ির চালক পালিয়ে এসে সাবিরকে ঘটনার কথা জানালেও সে বিষয়টি চেপে গিয়েছিল। পুলিশের সন্দেহ, সাবির এখন এ সব কথা বলে নিজে বাঁচতে চাইছে।
তবে গাইডদের সবাই যে দুষ্কৃতী, এমনটাও নয়। বরং পুলিশ সূত্রের একাংশের দাবি, সদর স্ট্রিটের গাইডদের কাজে লাগান গোয়েন্দারাও। মাঝরাতে থানায় বিদেশির অভিযোগ বুঝতে ঘুম থেকে এই গাইডদের অনেককে তুলে আনাও বিরল ঘটনা নয়।
ষাটের দশকে ‘গাইড’ সিনেমায় ‘গাইড’ দেব আনন্দের প্রেমে পড়েছিলেন ওয়াহিদা রহমান। সদর স্ট্রিটেও প্রেমের গল্পেরও অভাব নেই। আর বিয়ে? খোদ শাহিদের স্ত্রী-ই জাপানি! আর এক অভিযুক্ত সাবিরের স্ত্রীও জাপানি। স্ত্রীর সূত্র ধরে জাপানেও গিয়েছিল শাহিদ।