রাম-শ্যাম-যদু নয়, খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নিরাপত্তাতেই একগাদা ফাঁক গত এক মাসে ধরা পড়েছে বলে পরিষ্কার জানাল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
আল কায়দার হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে যখন সন্ত্রাসবাদী হামলার আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেই সময়ে মোদীর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এত ত্রুটি বেরিয়ে পড়ার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক উদ্বিগ্ন।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ, দিল্লির বাইরে মোদীর যে সব অনুষ্ঠান ও সফর ছিল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সেই সব জায়গাতেই নিরাপত্তার ত্রুটিগুলি চিহ্নিত করেছে। মন্ত্রকের বক্তব্য, কয়েকটি জায়গায় অনুষ্ঠানস্থলের প্রবেশপথে লোকজনের উপর বৈদ্যুতিন তল্লাশি চালানোর যন্ত্র ডোর ফ্রেম মেটাল ডিটেক্টর (ডিএফএমডি) এবং ব্যাগ ও জিনিসপত্র পরীক্ষার সরঞ্জাম এক্স-রে স্ক্যানার বসানো হলেও সেগুলি অকেজো ছিল। একে ‘নিরাপত্তার গুরুতর ত্রুটি’ বলে অভিহিত করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
আবার প্রধানমন্ত্রী পৌঁছনোর সময়ে একটি বায়ুসেনার ঘাঁটিতে দেখা গিয়েছে, উচ্চপদস্থ এক অফিসারের জন্য বরাদ্দ প্রবেশপত্র নিয়ে মূল অনুষ্ঠানস্থলে ঢুকে পড়েছেন তাঁর চেয়ে অনেক অধস্তন এক অফিসার। কোথাও আবার একটি বিমানবন্দরের পার্কিং এলাকার কাছে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্মিত মঞ্চের কাছে বিদ্যুতের ফুলকি নজরে এসেছে। বিদ্যুতের তার আলগা ভাবে লাগানোয় শর্ট সার্কিটই এর কারণ বলে পরে ধরা পড়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, মোদীর প্রতিটি অনুষ্ঠানের জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো ও তার ছবি স্ক্রিনে দেখে নজরদারির বন্দোবস্ত থাকতে হবে।
মন্ত্রকের কর্তাদের উদ্বেগের বড় কারণ, সেপ্টেম্বরের গোড়ায় প্রকাশ্যে এসেছে আল কায়দার বর্তমান প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরির একটি ভিডিও টেপ। যেখানে জাওয়াহিরি ভারতের মাটিতে সন্ত্রাস ছড়ানোর হুমকি দিয়েছেন এবং সেই প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন গুজরাত, আমদাবাদের কথাও। প্রসঙ্গত, গুজরাত দাঙ্গার পরেই নরেন্দ্র মোদীকে নিজেদের এক নম্বর ‘টার্গেট’ বলে ঘোষণা করেছিল লস্কর-ই-তইবার মতো জঙ্গি সংগঠন। এ বছর মে মাসে মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর নিরাপত্তার ঝুঁকি এমনিতেই বেড়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে আল কায়দা প্রধানের ভিডিও টেপ সামনে আসার ফলে তৈরি হওয়া সন্ত্রাসের আশঙ্কার আবহে কী করে নরেন্দ্র মোদীর নিরাপত্তায় ছিদ্র তৈরি হতে পারল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সেটাই প্রশ্ন। তার উপর ২ অক্টোবর বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের সূত্রে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, ভারত ও বাংলাদেশের জঙ্গিরা একযোগে পশ্চিমবঙ্গে বসে বিস্ফোরক ও শ’য়ে শ’য়ে আইইডি তৈরি করে দু’দেশেই বড়সড় নাশকতার ছক কষেছে।
দিন কয়েক আগেই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইনটেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি)-র সহ-অধিকর্তা যশপাল সিংহ দেশ জুড়ে পাঠানো এক সতর্কবার্তায় প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় নজরে আসা ওই ফাঁকফোকর একের পর এক উল্লেখ করেছেন। ওই একই সতর্কবার্তায় আল কায়দা প্রধানের ঘোষণার কথা গুরুত্ব সহকারে জানিয়ে সে কথা মাথায় রেখে মোদীর মতো ভিভিআইপি-দের নিরাপত্তা ও সামগ্রিক ভাবে দেশের সুরক্ষা ব্যবস্থা যতটা সম্ভব নিশ্ছিদ্র করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আইবি জানিয়েছে, যেখানে যেখানে ত্রুটি ধরা পড়েছে, তার মধ্যে একটি অনুষ্ঠানকেন্দ্রের প্রবেশপথে প্রধানমন্ত্রী পৌঁছনোর ১০ মিনিট আগেও গাড়ি ও লোকজন অবাধে ঢুকতে দেওয়া হয়েছিল এবং পরিচয়পত্র দেখতে চাওয়া ও তল্লাশির কোনওটাই হয়নি। অন্য একটি জায়গায় হেলিপ্যাড থেকে সভামঞ্চ পর্যন্ত মোদী যে পথে হেঁটে গিয়েছেন, তার দু’পাশে দড়ি বা ব্যারিকেডের কোনও ব্যবস্থা ছিল না। প্রধানমন্ত্রী অনেক ক্ষণ সময় কাটান, এমন একটি রাজভবনে মোদীকে অভ্যর্থনা জানানো পুলিশকর্মী ও অন্য সরকারি কর্মীদের সচিত্র পরিচয়পত্র ছিল না।
ওই সতর্কবার্তায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, প্রায় সর্বত্রই মোদীর সভাস্থল বা অনুষ্ঠানস্থলে প্রচুর ভিড় হচ্ছে ও কয়েকটি জায়গায় ইংরেজি ‘ডি’-এর আকারে তৈরি সুরক্ষা বলয়ের মধ্যেও জনতা জোর করে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু এটা কোনও ভাবেই হতে দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে ব্যারিকেডকে দ্বিগুণ শক্তিশালী করতে হবে বলে জানিয়েছে আইবি। এ বছর ১৬ মে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে নরেন্দ্র মোদীর শপথ নেওয়ার ১০ দিন আগে ভোপালের একটি আদালতে আসামি হিসেবে হাজির হওয়া সিমি (স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া)-র কয়েক জন সদস্য স্লোগান তুলেছিল, ‘‘আব কি বার/মোদী কা নাম্বার। এ বার খতম হওয়ার পালা মোদীর।” গত বছর পটনার গাঁধী ময়দানে মোদীর সভাস্থলে ধারাবাহিক বিস্ফোরণের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত হায়দার আলি এ বছর মে মাসে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র হাতে ধরা পড়ে। আইবি সূত্রের খবর, সিমি-র প্রাক্তন সদস্য এবং সিমি নিষিদ্ধ হওয়ার পরে কালেদিনে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন (আইএম)-এর রাঁচি মডিউলের চাঁই হায়দার জুলাই মাসে আইবি-র জেরায় জানায়, মোদীর উপর হামলা চালানোর জন্য সে একটি আত্মঘাতী বাহিনী তৈরি করেছে। আইবি-র এক কর্তার বক্তব্য, ২৬/১১-র পর লস্কর ভারতে ফের অভূতপূর্ব কোনও জঙ্গি হামলার ছক কষছে এবং আমজনতার পরিবর্তে এ বার হামলার লক্ষ্য হতে পারেন কয়েক জন রাজনৈতিক নেতা, যাঁদের তালিকার শীর্ষে স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী। ওই অফিসারের কথায়, “ভিড়ে মিশে থাকা মাত্র এক জনও নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে।” তার পরেও গত এক মাসে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় কী করে এত গাফিলতি থেকে গেল, তা নিয়েই এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দুশ্চিন্তা।