সরস্বতী থেকে চাঁদমালা, মাউস ক্লিকেই বেঙ্গালুরু

সকাল সকাল উঠে স্নান। বইপত্তর ঝেড়েঝুড়ে প্রতিমার পায়ের কাছে। তার পর পাঞ্জাবি-পাজামা বা শাড়ি পরে হাতজোড় করে অঞ্জলি, ‘বীণা রঞ্জিত পুস্তক হস্তে ভগবতী ভারতী...।’ সরস্বতী পুজোর দিনের সেই ছবিটাই তো মনের কোণে লুকিয়ে ছিল আট বছর ধরে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির শহরে সেই সুখ কোথায়! বেঙ্গালুরুতে মনের মতো প্রতিমা নেই। দক্ষিণী আদলের মুখ। প্রতিমার সাজপোশাক, অলঙ্কারও দক্ষিণ ভারতীয় নকশার। পুজোর সামগ্রীও ঠিকঠাক মেলে না। পুজোর ঘট পাওয়া গেল তো ঘটের গামছা নেই। চাঁদমালা আছে তো মধুপর্কের বাটি নেই। অঞ্জলি দেওয়ার পরে সেই কুলে কামড় দেওয়া নেই! কী করে মন ভরে?

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:০৭
Share:

সকাল সকাল উঠে স্নান। বইপত্তর ঝেড়েঝুড়ে প্রতিমার পায়ের কাছে। তার পর পাঞ্জাবি-পাজামা বা শাড়ি পরে হাতজোড় করে অঞ্জলি, ‘বীণা রঞ্জিত পুস্তক হস্তে ভগবতী ভারতী...।’

Advertisement

সরস্বতী পুজোর দিনের সেই ছবিটাই তো মনের কোণে লুকিয়ে ছিল আট বছর ধরে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির শহরে সেই সুখ কোথায়! বেঙ্গালুরুতে মনের মতো প্রতিমা নেই। দক্ষিণী আদলের মুখ। প্রতিমার সাজপোশাক, অলঙ্কারও দক্ষিণ ভারতীয় নকশার। পুজোর সামগ্রীও ঠিকঠাক মেলে না। পুজোর ঘট পাওয়া গেল তো ঘটের গামছা নেই। চাঁদমালা আছে তো মধুপর্কের বাটি নেই। অঞ্জলি দেওয়ার পরে সেই কুলে কামড় দেওয়া নেই! কী করে মন ভরে?

যাদবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বেঙ্গালুরুতে চাকরি করতে আসার পর থেকেই সোমনাথ ও অয়ন মিস করতেন এই সব। শুধু ওঁরা নন, কলকাতার হাজার হাজার ছেলেমেয়ে এখন বেঙ্গালুরুতে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে কাজ করছেন। সপ্তাহান্তে বাঙালি রেস্তোঁরায় লম্বা লাইন পড়ে। মাছের দোকানের মালিকরা বাংলা জানা কর্মচারী রাখেন। হায়দরাবাদ, পুণে, গুড়গাঁও, নয়ডাতেও তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলোয় বাঙালিদের ছড়াছড়ি। এই প্রজন্মের হাতে আই প্যাড উঠলেও সরস্বতী পুজোর অঞ্জলি দিতে না পারলে মন খুঁতখুঁত। কিন্তু সাজসরঞ্জাম?

Advertisement


সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

ভাবতে ভাবতে পথ বের করলেন নিজেরাই। অনলাইনে কেনাবেচায় তো এখন কোনও কিছুই বাকি নেই। তা হলে বাংলার আদলে মাটির সরস্বতী প্রতিমাই বা নয় কেন? যেমন ভাবা তেমনি কাজ। মাউসের এক ক্লিকেই যদি কলকাতা থেকে বেঙ্গালুরুর ফ্ল্যাটের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায় প্রতিমা, পুজোর সামগ্রী? গোটা দেশে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা বাঙালিকে খুশি করতে নেমে পড়েছেন জোকার সোমনাথ সামন্ত আর বরাহনগরের অয়ন চৌধুরী। দু’জনেই এখন বেঙ্গালুরুতে একটি বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত। তাঁদের সঙ্গে জুটেছেন সোমনাথের দাদা, কলকাতার ব্যবসায়ী সৌমেন। তিন জনে মিলে অনলাইনে সরস্বতী পুজোর প্রতিমা ও সামগ্রী বেচা শুরু করেছেন। প্রথমে ভেবেছিলেন, বেঙ্গালুরুর বন্ধুবান্ধবদের মুখে হাসি ফোটালেই যথেষ্ট। কিন্তু এখন? রাজস্থান থেকে চেন্নাই চাহিদা তুঙ্গে। বাদ নেই খাস কলকাতাও।

প্রতিমা পাড়ি দিয়েছে হায়দরাবাদ, মুম্বই, ভুবনেশ্বরে। প্রতিমা হাতে পাওয়ার পরে টাকা দেওয়ার সুবিধা (ক্যাশ অন ডেলিভারি) দেওয়া হচ্ছে শুধু কলকাতা এবং বেঙ্গালুরুতে। অন্য জায়গায় অবশ্য আগে থেকেই টাকা দিতে হবে। তিন-চার দিনে পৌঁছে যাচ্ছেন সরস্বতী। বেঙ্গালুরুতে অন্তত ৩০টি প্রতিমা বিক্রি করেছেন ওঁরা। বাকি সব শহরে ১০০টির মতো মূর্তি পাঠানো হয়েছে। তবে এই গোটা উদ্যোগে ব্যবসায়িক দিকটি নয়, সোমনাথ-অয়নরা গুরুত্ব দিয়েছেন বাঙালি আবেগকে। লক্ষ্য ছিল এ বারের সরস্বতী পুজো। কিন্তু সব শুরু করতে কিছুটা দেরি হয়ে গিয়েছিল অয়নদের। তাতেও যা সাড়া মিলেছে, ওঁরা সন্তুষ্ট। মাটির মূর্তি আর পুজোর সামগ্রী যাতে ভেঙে না যায়, তার জন্য প্যাকেজিংয়ে যথেষ্ট যত্ন নিয়েছেন ওঁরা।

মুম্বইয়ের বিশ্বজিৎ রায় বা বেঙ্গালুরুর তাপসী ভট্টচার্য সেই প্যাকেজিং দেখে মুগ্ধ। হায়দরাবাদের অর্ণব বললেন, “ওরা ফোন করে খোঁজও নিয়েছে ঠিকমতো জিনিস পেয়েছি কি না। খুবই ভাল।”

ওয়েবসাইট তৈরি, বিপণন, ফেসবুকে প্রচার, অন্য ই-কমার্স সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া, প্রতিমা হাতে পাওয়ার পর কিংবা অনলাইনেই টাকা মেটানোর ব্যবস্থা করার দায়িত্ব দুই ইঞ্জিনিয়ারের। কী ভাবে বিপণন হচ্ছে? অয়নের জবাব, “বেঙ্গালুরুই আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল। হ্যাল মার্কেটের মতো যে সব বাজারে মাছের দোকানে বাঙালিদের আনাগোনা, সেখানে পোস্টার দেওয়া হয়েছে। ফেসবুকে প্রচার হয়েছে। বাঙালি কমিউনিটিগুলোতেও প্রচার করেছি আমরা।” শুধু প্রতিমা আর পুজোর সামগ্রী নয়। আসছে আরও নানা আবদার। চেন্নাই থেকে যেমন এক জন বলেছেন, গোটা চারেক কুল পাঠিয়ে দিন না! প্রবাসে থেকে কলকাতার জন্য এমন মন হাঁকুপাকু যে, কুলের স্বাদ পেতে আরও পাঁচশো টাকা খরচ করতেও রাজি। কলকাতা থেকে ফোনে হাসতে হাসতে সৌমেন বলছিলেন, “বিমানে ভাল প্যাকিং করে পাঠাতে হবে বলে আমরা এক ফুট উচ্চতার মাটির ছাঁচের তৈরি মূর্তি দিচ্ছি। অনেকে আরও বড় মূর্তি চাইছেন। সকলেরই চাহিদা, শাড়ি, শোলার গয়না, মুকুট পরানো ঠাকুর চাই। তার জন্য পাঁচ হাজার টাকা দিতেও রাজি।” অয়নের কাছে আরও ‘কঠিন’ আবদার এসেছে। রাজস্থানের পিলানি থেকে একজন ফোন করে জানতে চেয়েছেন, পলাশ ফুল পাঠাতে পারবেন?

এই ‘প্যাকেজে’ আলপনা দেওয়া ঘট, দোয়াত-কলম, প্রদীপ, চাঁদ-মালা, চন্দন-গুঁড়ো, পাঁচ কলাই থেকে লাল সুতো, তিরকাঠি, পঞ্চরত্ন, মধুপর্কের বাটি সবই রয়েছে। পুজোর মন্ত্রের বই, আসন, সাজানোর সামগ্রীও। সরস্বতী পুজোর সময়ই ছোটদের হাতেখড়ি হয়। তার জন্য স্লেট আর চকও পাঠানো হচ্ছে। সৌমেন দত্তপুকুর থেকে নাগেরবাজার ঘুরে এ সব জোগাড় করে পাঠানোর বন্দোবস্ত করছেন। কলকাতায় থাকলেও যাদের বাজার করার সময় নেই, তারাও অনলাইনে সরস্বতী পুজোর বাজারটা সারতে পারেন এর পর থেকে। অর্ধেক দামে মিলবে সব কিছু। এ বার প্রচার শুরু করতে দেরি হয়েছিল বলে অনেক বরাত ফিরিয়ে দিতে হয়েছে।

এর পরে কি ‘মিশন দুর্গাপুজো’? অয়নের জবাব, “ওরেব্বাবা! এখনই ভাবছি না। তবে লক্ষ্মীপুজোর মতো বাড়ির পুজোগুলোয় মাঠে নামব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন