২-৩ মিনিট! তলিয়ে গেল বন্ধুরা

তিন দিনের টানা সফরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন পড়ুয়ারা। শিক্ষকদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তাই নেমে পড়েন ফিতের মতো বয়ে চলা বিপাশায়। নদীর উপর পড়ে থাকা বোল্ডারগুলোয় বসে আড্ডায় মেতে ওঠেন। ঘুণাক্ষরেও টের পাননি পায়ের তলায় জল বাড়ছে। তার পর আর ২-৩ মিনিট! গত কাল বিপাশার বাঁধ থেকে ছাড়া জল টেনে নিয়ে গিয়েছে অন্তত ২৪ পড়ুয়াকে। বেশ কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় উদ্ধার করা গিয়েছে পাঁচ জনের দেহ। বাকিদের খোঁজ নেই এখনও।

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

মান্ডি শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৪ ০৩:৩৪
Share:

বেঁচে ফেরা পড়ুয়াদের সঙ্গে বীরভদ্র সিংহ।

তিন দিনের টানা সফরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন পড়ুয়ারা। শিক্ষকদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তাই নেমে পড়েন ফিতের মতো বয়ে চলা বিপাশায়। নদীর উপর পড়ে থাকা বোল্ডারগুলোয় বসে আড্ডায় মেতে ওঠেন। ঘুণাক্ষরেও টের পাননি পায়ের তলায় জল বাড়ছে।

Advertisement

তার পর আর ২-৩ মিনিট! গত কাল বিপাশার বাঁধ থেকে ছাড়া জল টেনে নিয়ে গিয়েছে অন্তত ২৪ পড়ুয়াকে। বেশ কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় উদ্ধার করা গিয়েছে পাঁচ জনের দেহ। বাকিদের খোঁজ নেই এখনও।

পরীক্ষার শেষে বন্ধুদের সঙ্গে কলেজের সফরটার পরিণতি যে এ রকম হবে, কল্পনাও করতে পারছেন না বেঁচে ফেরা পড়ুয়ারা। হোটেলের ঘরে বসে আজ এমনই সব কথা বলছিলেন হায়দরাবাদের ওই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র রবি কুমার। নদীর পাড়ের দিকে ছিলেন তিনি। বলছিলেন, “জল বাড়ছে দেখে তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করি...। ছুটে যাই বন্ধুদের কাছে। কিন্তু তার মধ্যেই জল হু হু করে বেড়ে গিয়েছে।” হাজার চেষ্টা করেও মাথা থেকে ওই ভয়াবহ মুহূর্তগুলোর স্মৃতি মুছে ফেলতে পারছেন না রবি।

Advertisement

একই অবস্থা ১৯ বছরের টি ভি সুহর্ষেরও। জানান, ৪৮ জনের দলটাতে ১৩ ছাত্রী ছিলেন। শিক্ষক তিন জন। তাঁদের মধ্যে এক জন আবার সঙ্গে করে বাচ্চাকেও নিয়ে গিয়েছিলেন। ঘটনার সময় ঠিক ক’টা বেজেছিল ঘড়িতে, মনে করতে পারলেন না সুহর্ষ। বললেন, “সাড়ে পাঁচটা থেকে ছ’টা হবে। তিন দিন টানা ঘুরে বেড়ানোর পর সবাই তখন একটু বিশ্রাম চাইছিল।” তাই বিপাশার ধার ঘেঁষে মানালি-কিরাটপুর হাইওয়ে ধরে যাওয়ার পথে সবাই মিলে ঠিক করেন নদীর ধারে একটু থামবেন। শিক্ষকদের জিজ্ঞাসা করতেই ছাড়পত্র মিলে যায়।

সুহর্ষর কথায়, “আমরা তখন পাথরগুলোর উপর বসে নিজেদের ছবি তুলতে ব্যস্ত। কেউ বা আশপাশের শোভা দেখছে। নদীর মাঝখানটায় বিশাল পাথর ছিল। সবাই চেষ্টা করছিল কোনও ভাবে সেখানে পৌঁছতে। ছোট ছোট পাথরের উপর পা ফেলে অনেকে চলেও গিয়েছিল ওখানে। এ ভাবেই কেটে যায় মিনিট দশেক। আমি পাড়ের দিকে ছিলাম। সবার প্রথমে আমারই নজরে পড়ে, জল যেন বাড়ছে! বন্ধুদের সতর্ক করতে পাগলের মতো চেঁচাতে শুরু করি।” কিন্তু চেঁচানোই সার। সুহর্ষর চোখের সামনেই ভেসে যায় ১৫-২০ জন। তাঁর কথায়, “জলের মধ্যে এক জনের মাথা দেখতে পেলাম। বেঁচে আছে কি না বুঝিনি। একটা দড়ি ছুড়ে দিই। ধরতে পারল না... চোখের সামনেই হারিয়ে গেল ও।”

সুহর্ষ, রবি কুমারদের অভিযোগ, তাঁরা জানতেন না ওখানে কোনও বাঁধ আছে। বিপদ সঙ্কেত লেখা বোর্ডও ছিল না পাড়ের দিকে। সাইরেনও বাজেনি জল ছাড়ার আগে। আর এক ছাত্র বলেন, “আমরা যখন নদীতে নামি, সে রকম জল ছিল না। স্থানীয় লোককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, নদীতে নামা নিরাপদ হবে কি না। ওঁরা না করেননি।” পড়ুয়াদের দাবি, ঘটনার পর পুলিশ অনেক দেরিতে আসে। ক্ষোভ উগরে তাঁরা বলেন, “তাড়াতাড়ি যে উদ্ধার কাজ শুরু করা দরকার, ওদের মধ্যে সে রকম কোনও আগ্রহই দেখতে পেলাম। না হলে হয়তো...।”

প্রশাসনের গাফিলতি নিয়ে অবশ্য বক্তব্য রাখা হয়নি রাজ্যের তরফে। বরং জানানো হয়েছে, পুলিশ, সেনা ও ডুবুরিদের নিয়ে ৭০ সদস্যের একটি দল গড়া হয়েছে। সকাল থেকে বহু চেষ্টার পর মাত্র এক জনেরই দেহ পাওয়া যায় । অন্য চার জনের মৃতদেহ মেলে পানডো বাঁধের কাছে।

ছেলে আর নেই। কান্নায় ভেঙে পড়েছেন এক ছাত্রের বাবা।

এক সেনা-কর্তার কথায়, “নদীতে এখন প্রচুর জল। তার উপর আবার নৌকার সংখ্যাও বেশ কম। সে জন্য উদ্ধার কাজ কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। তবে জওয়ানরা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। খুব সাহায্য করছেন ১২ জন ডুবুরিও।” প্রশাসনের গাফিলতি বা দেরিতে আসা নিয়ে সরকার মুখ না খুললেও তড়িঘড়ি সাসপেন্ড করা হয়েছে লারজি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের দুই অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার এবং এক কর্মীকে। ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী বীরভদ্র সিংহ। তবে সাইরেন না বাজার তত্ত্ব হেলায় উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্টই জানিয়েছেন “সাইরেন বাজানো হয়েছিল। ছাত্ররা তা শুনতে পাননি।” যদিও সে দাবি মানতে রাজি নন পড়ুয়ারা।

দুর্ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানিও। যে হোটেলে ছাত্রছাত্রীরা উঠেছিলেন, সেখানেও যান তিনি। তবে দুর্ঘটনার কারণ জানতে চাইলে পুরোপুরি এড়িয়ে যান। স্পষ্টই জানিয়ে দেন, সরকার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। রিপোর্ট হাতে পাওয়ার আগে কোনও মন্তব্য করবেন না। রাজ্যের কাছে তদন্ত রিপোর্ট চেয়েছে হিমাচল প্রদেশ হাইকোর্টও।

রাতে উদ্ধার কাজ আপাতত স্থগিত। ফের শুরু হবে কাল সকালে। তবে মান্ডির কন্ট্রোল রুমে সোমবার রাতেও ঘন ঘন বেজেছে টেলিফোন। যদি কোনও সুখবর মেলে! সন্তানদের এ হেন পরিণতিতে মাথায় আকাশ ভেঙেছে বাবা-মায়েদের। সকাল থেকে হায়দরাবাদে কলেজের সামনে ভিড় করেন তাঁরা। ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন অনেকেই। অভিযোগ, কলেজের তরফে দুর্ঘটনার খবরই জানানো হয়নি তাঁদের। এক অভিভাবকের কথায়, “ছেলেই জানিয়েছিল, পরীক্ষা শেষ। বেড়াতে যাচ্ছি। কিন্তু সেটা শিক্ষামূলক ভ্রমণ, নাকি পিকনিক... কলেজের তরফে জানানো হয়নি আমাদের। খবর দেওয়া হয়নি দুর্ঘটনার পরও।” আর এক পড়ুয়ার বাবার কথায়, “রাতের অন্ধকারে কেন নদীতে নামার অনুমতি দিলেন শিক্ষকরা?” চুপ কলেজ কর্তৃপক্ষ।

ছবি: পিটিআই

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন