শূন্য শিকারাগুলি সার সার দাঁড়িয়ে আছে। ছবি: শাটারস্টক।
এ রকমও যে ঘটে এখনও, আগে তেমন টের পাইনি!
গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে লাদাখ ভ্রমণ সেরে কাশ্মীরে এসেছি। শহরে ঢুকেই টের পেলাম, গত এপ্রিল মাসের পহেলগাঁও ঘটনার দুঃস্বপ্ন শ্রীনগর এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ডাল লেকের চারপাশে ভ্রমণার্থীদের যে মাদকতা দেখা যায় ট্যুরিস্ট সিজ়নে, তার কণামাত্র নেই। হাউস বোটগুলি সার সার দাঁড়িয়ে আছে। একটি-দুটি ছাড়া বাকি সব যেন ক্ষুধিত পাষাণ!
ডাল লেকে যে শিকারাগুলি ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ঘুরে বেড়ায় উচ্ছ্বসিত ভ্রমণার্থীদের কলরব-সহ, তা-ও দেখা যাচ্ছে না। দু’-চারটি শিকারা দেখা যাচ্ছে, আর নানা রকম বাণিজ্যিক পসরা নিয়ে বেশ কয়েকটি শিকারা তাদের কাছে ঘেঁষতে চাইছে। কিন্তু প্রাণের স্পন্দন নেই। ম্রিয়মাণ বিক্রেতাদের চোখমুখ। বোঝা যাচ্ছে, ক্রেতার অভাবে তাঁদের রুজি-রোজগার সব বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
ভ্রমণার্থী নেই পর্যটনের মরসুমে। ছবি: সংগৃহীত।
আমাদের শিকারাটি লেকে চড়ে বেড়াচ্ছিল তার আপন নিয়মে। ঘণ্টাখানেক চলা তার দস্তুর। শিকারাচালকের সঙ্গে অনুচ্চ কণ্ঠে কথাবার্তা চলছে আমাদের। চালক বলছেন, তাঁর বা তাঁদের দুঃখের বারোমাস্যা। কাশ্মীর এখন ট্যুরিস্টশূন্য! এক একটা অদ্ভুত বিভীষিকাময় ঘটনা ঘটে আর তার জেরে বেশ কিছুকাল ভ্রমণার্থীদের আসা-যাওয়া চলে যায়। ট্যুরিস্ট নির্ভর এক বড় মাপের ব্যবসায়ীদের কপাল ফাটে। জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনাদের অন্য কোনও জীবিকা সংস্থান নেই?” শিকারাচালক বললেন, “কী আর থাকবে! আমাদের মূলধন কোথায় যে, অন্য কিছু করব!”
ঠিক কথা। সাধারণ জীবিকার মানুষজন বিকল্পের কথা ভাবতে চাইলেই ভাবা সহজ নয়। তা হলে চলে কী করে? এই প্রশ্নের জবাবে শিকারাচালক জানালেন, “চলে না তো! কোনও রকমে দিনাতিপাত করছি। তবে একটা উপায় আমরা খুঁজে পেয়েছি।’’ কী সেটা? প্রশ্নের জবাবে শিকারাচালক যা বললেন, সেটা শুনে আমাদের মনে হয়েছিল, এ রকমও যে ঘটে এখনও, তা আগে তেমন টের পাইনি।
ঘটনাটা কী? শিকারা চালক বলেন, “আমাদের এই ডাল লেকে এখন ৬৭টি শিকারা আছে। বাইরের ট্যুরিস্ট কম হলেও এলাকার মানুষজনেরও তো সাধ-আহ্লাদ আছে। তাঁরাও ডাল লেকে ঘোরাঘুরি করেন। তাতে আমাদের কিছু উপার্জন হয়।’’ শিকারাচালক বলতে থাকেন, “আগে ভরা মরসুমে যখন পর্যটকদের আসা-যাওয়া চলত, আমরা এক এক জন শিকারাচালক সপ্তাহে ১০-১২ হাজার টাকা অনায়াসে উপার্জন করতাম। মাসে প্রায় ৪০,০০০ টাকা। কিন্তু এই ভাঙা হাটে আমাদের মাসিক আয় ১০,০০০ টাকাও হয় না। তাই আমরা একটা সম্মিলিত তহবিল তৈরি করেছি। ৬৭ জন শিকারাওয়ালা তাঁদের মাসিক উপার্জন এক জায়গায় করেন। তার পর সকলের মধ্যে তা সমান ভাবে বণ্টিত হয়। দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার এটাই একমাত্র উপায়।’’
একটি-দুটি ছাড়া বাকি সব শিকারা যেন ক্ষুধিত পাষাণ! ছবি: সংগৃহীত।
কথাগুলো শুনে শিহরিত হলাম। মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথের সমবায় চিন্তার কথা। শিলাইদহে পল্লি উন্নয়নের ব্রত যখন তিনি গ্রহণ করেছিলেন, তখন বার বার কবি সমবায়ের কথা বলতেন। হাতে-কলমে কিছু ব্যবস্থাও করেছিলেন। এই সমবায়ের একটি দর্শন আছে। এই দর্শনের কথা রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই বলি, “সকল দেশেই গরিব বেশি, ধনী কম। তাই যদি হয় তবে কোন দেশকে বিশেষ করিয়া গরিব বলিব? এ কথার জবাব এই, যে দেশে গরিবের পক্ষে রোজগার করিবার উপায় অল্প, রাস্তা বন্ধ। যে দেশে গরিব ধনী হইবার ভরসা রাখে, সে দেশে সেই ভরসাই একটা মস্ত ধন। আমাদের দেশে টাকার অভাব আছে, এ কথা বলিলে সবটা বলা হয় না। আসল কথা, আমাদের দেশে ভরসার অভাব। তাই যখন আমরা পেটের জ্বালায় মরি, তখন কপালের দোষ দিই, বিধাতা কিংবা মানুষ যদি বাহির হইতে দয়া করেন, তবেই আমরা রক্ষা পাইব, এই বলিয়া ধূলার উপর আধমরা হইয়া পড়িয়া থাকি। আমাদের নিজের হাতে যে কোনও উপায় আছে, এ কথা ভাবিতেও পারি না। এই জন্যই আমাদের দেশে সকলের চেয়ে দরকার, হাতে ভিক্ষা তুলিয়া দেওয়া নয়, মনে ভরসা দেওয়া।’’
ডাল লেকের শিকারা চালকদের সমবায় পন্থা অর্থাভাব তেমন ঘোচাতে পারবে বলে মনে হয় না, অন্তত এই মুহূর্তে। কিন্তু ভরসা যে জোগাতে পারছে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এই ভরসা থেকেই সফল সমবায় আর্থিক উন্নতির পথও দেখাবে।
(লেখক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক)