হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন

আইন নেই কেন, প্রশ্ন রেখে চলে গেল অলঙ্কৃত

বিস্মিত মন্ত্রীর প্রশ্ন, এমন আবার হয় নাকি! চিকিৎসদের দাবি, আইন থাকলেই হয়। কিন্তু এ রাজ্যে সেই আইন নেই বলেই নষ্ট হল বহুমূল্য সময়। আর তার মধ্যেই থেমে গেল একরত্তি ছেলেটার ধুকপুকুনি।

Advertisement

সুনন্দ ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:০৯
Share:

বিস্মিত মন্ত্রীর প্রশ্ন, এমন আবার হয় নাকি!

Advertisement

চিকিৎসদের দাবি, আইন থাকলেই হয়।

কিন্তু এ রাজ্যে সেই আইন নেই বলেই নষ্ট হল বহুমূল্য সময়। আর তার মধ্যেই থেমে গেল একরত্তি ছেলেটার ধুকপুকুনি।

Advertisement

উল্টোডাঙার অশোক ও রুমেলা দে-র বিয়ের দশ বছর পরে জন্মায় তাঁদের ছেলে অলঙ্কৃত। আর পাঁচটা বাচ্চার মতো দৌড়ে-হেসে-খেলে বেড়াত সে। কলকাতার এক নামী স্কুলে নার্সারিতে ভর্তিও হয়েছিল। কিন্তু এই বছরের জুন মাস থেকে আচমকা শুরু হয় বমি। কলকাতার একটি বড় হাসপাতালে ভর্তি করার পরে জানা যায়, সাধারণ ক্ষেত্রে প্রতি মিনিটে যে গতিতে হৃদ্‌যন্ত্র রক্ত পাম্প করে, ছ’বছরের ছেলেটার হৃৎপিণ্ড তা পারে
না। সেই হাসপাতালের চিকিৎসক ঋতব্রত দাসের কথায়, ‘‘ওর হৃৎপিণ্ডের পেশি দুর্বল। কেন, তার কারণ জানা যায়নি। তাই প্রতিস্থাপন ছাড়া উপায় ছিল না।’’

কিন্তু হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করার জন্য যে পৃথক আইনের প্রয়োজন, এ রাজ্যে তো তা নেই। আর তাই অলঙ্কৃতের পাশে দাঁড়াতে পারেনি এ রাজ্যের কোনও হাসপাতাল। এ রাজ্যে কিছুই করা যাবে না দেখে ভিন্ রাজ্যে ছুটে গিয়েছিলেন অলঙ্কৃতের বাবা-মা। কিন্তু এই টানাপড়েনে নষ্ট হয়ে যায় বহুমূল্য তিনটি মাস। অলঙ্কৃতের হাতে যে-টুকু সময় ছিল, তাতে তার প্রয়োজনীয় ছোট্ট মাপের হৃৎপিণ্ড জোগাড় করা যায়নি।

অথচ কার্ডিও-থোরাসিক সার্জেন সত্যজিৎ বসু বলছেন, ‘‘আমরাও হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করতে পারি। দুর্গাপুর মিশন হাসপাতালেই তিন জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। কিন্তু তার জন্য রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে আইন করতে হবে।’’ পূর্ব ভারতের সব হাসপাতাল নিয়ে তৈরি সংগঠনের সভাপতি চিকিৎসক রূপালি বসুও বললেন, ‘‘চিকিৎসাবিজ্ঞানে গত ৩০ বছরে চেন্নাই অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। আমাদের অগ্রগতির যাত্রা শুরু বছর দশেক আগে। এখন কলকাতায় হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। সেই পরিকাঠামো রয়েছে। কিন্তু তা করার আইন নেই। সেটার প্রয়োজন।’’

কী বলছে রাজ্য?

হৃৎপিণ্ডও যে প্রতিস্থাপন করা যায়, সে সম্পর্কে পুরোপুরি অন্ধকারে রাজ্যের স্বাস্থ্য-প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। যিনি আবার রাজ্যের আইনমন্ত্রীও! তাঁর অবাক প্রশ্ন, ‘‘হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপিত হয় নাকি? সে কি সম্ভব? এমনটা হলে তা বিরল ঘটনা।’’ তাঁকে জানানো হল, চেন্নাইয়ের বিভিন্ন হাসপাতালে আকছার এমন অস্ত্রোপচার হয়ে থাকে। যা শুনে চন্দ্রিমাদেবী বললেন, ‘‘অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের একটি আইন রয়েছে। আমরা সেই আইন মেনে চলি।’’ এ রাজ্যে কবে এমন প্রতিস্থাপন হওয়া সম্ভব? সদুত্তর দিতে পারেননি চন্দ্রিমাদেবী।

কর্নাটক, তামিলনাড়ুর মতো যে সব রাজ্যে হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন হয়, সেখানে রয়েছে ‘ক্যাডাভ্যার ট্রান্সপ্লান্টেশন ল’, অর্থাৎ মস্তিষ্কের মৃত্যু হয়ে যাওয়ার পরে দেহ থেকে প্রতিস্থাপন করার জন্য অঙ্গ বার করে নেওয়ার প্রয়োজনীয় আইন। চিকিৎসকদের পরামর্শেই আচমকা কোনও দুর্ঘটনায় বা অন্য কারণে কেউ কোমায় চলে গেলে তাঁর পরিবারের অনুমতি নিয়ে হৃৎপিণ্ড তুলে নিয়ে অন্যের দেহে প্রতিস্থাপন করার ক্ষেত্রে চেন্নাই দেশের মধ্যে অগ্রগণ্য। দক্ষিণের এই শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের জন্য সারা বছর অনেক রোগী অপেক্ষায় থাকেন। হৃৎপিণ্ড সংগ্রহ করতে তামিলনাড়ু ও আশপাশের কিছু রাজ্যে হাসপাতালগুলোর বিশেষ দল ঘুরে বেড়ায়। চার থেকে ছ’ঘণ্টার মধ্যে হৃৎপিণ্ড তুলে এনে প্রতিস্থাপন করতে সাহায্য করেন ওই সব দলের সদস্য। কিন্তু আমাদের রাজ্যে এই আইনটি নেই। ফলে কোনও জীবিত ব্যক্তির অনুমতি নিয়ে শুধু কিডনির মতো অঙ্গ প্রতিস্থাপন সম্ভব। হৃৎপিণ্ডের প্রতিস্থাপন কখনওই সম্ভব নয়।

১৯৬৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে প্রথম হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করেছিলেন চিকিৎসক ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড। তার পর বিশ্ব জুড়ে কয়েক লক্ষ মানুষের হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপিতহয়েছে। সব চেয়ে বেশি হয়েছে আমেরিকায়। দীর্ঘদিন নিউজিল্যান্ডে ছিলেন হার্ট সার্জেন মনোজ দাগা। তার কথায়, ‘‘ও দেশে থাকতে ৭০-৮০টি হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করেছি। ‘ক্যাডাভ্যার ট্রান্সপ্লান্টেশন’ আইনের অভাবে, এ রাজ্যে এ ধরনের সার্জারি এখনও দূর অস্ত্‌।’’ ২৯ জুলাই চেন্নাইয়ের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল অলঙ্কৃতকে। সেখানে তার জন্য অনেক খুঁজে-পেতে চারটি হৃৎপিণ্ড পাওয়া গিয়েছিল। অলঙ্কৃতের রক্তের গ্রুপের সঙ্গে মিলে যায়, এমন গ্রুপেরও হৃৎপিণ্ডও ছিল। চেন্নাইয়ের হাসপাতালের কার্ডিওলজির প্রধান কে কে বালকৃষ্ণনের কথায়, ‘‘গত সপ্তাহেও একটি পেয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিটিই ওর শরীরের তুলনায় বড়।’’ মাত্র কুড়ি কিলোগ্রাম ওজনের বাচ্চাটির বুকের খাঁচার ভিতরে ঢুকে যেতে পারে, এমন হৃৎপিণ্ডের খোঁজ মেলার আগেই চলে গেল অলঙ্কৃত।

বালকৃষ্ণন অবশ্য আশাবাদী ছিলেন।
দিন কয়েক আগেও বলেছিলেন, ‘‘আর এক সপ্তাহের মধ্যে যদি ওর মাপমতো একটি হৃৎপিণ্ড পাওয়া যায়, তা হলে ওকে বাঁচিয়ে তোলা যাবে।’’ অশোক ও রুমেলা ২৯ লক্ষ টাকা জমা দিয়েছেন হাসপাতালে। অস্ত্রোপচারের খরচ বাবদ বাড়তি ১০ লক্ষেরও বন্দোবস্ত করে রেখেছিলেন। কিন্তু কাজে এল না কিছুই।

গত সপ্তাহে দু’বার হৃদ্‌যন্ত্র বিকল হয়ে গিয়েছিল ছেলেটার। বাইরে থেকে কৃত্রিম উপায়ে তার হৃদ্‌যন্ত্র চালানো হচ্ছিল। সোমবার চেন্নাই থেকে ফোনে ধরা গলায় অশোকবাবু বলেছিলেন, ‘‘মারাত্মক যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে ওর মাথার উপরেও চাপ পড়ছে। রবিবার রাতে ওর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণও হয়েছে, জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।’’ সে দিন থেকে ভেন্টিলেশনে থাকতে থাকতেই থেমে গেল স্পন্দন।

এ রাজ্যে আইন থাকলে হয়তো আরও আগে হৃৎপিণ্ডের খোঁজ পাওয়া যেত। বেঁচে যেত অলঙ্কৃত। শুধু আইন নেই বলে ভবিষ্যতেও কি এ রাজ্যের হাসপাতাল থেকে আবার কাউকে ভিন্ রাজ্যে ছুটতে হবে?

একরত্তি ছেলেটা প্রাণ দিয়ে সেই প্রশ্নই রেখে গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন