Pregnancy Tips

গর্ভধারণে ফ্যালোপিয়ান টিউবও জরুরি

গর্ভধারণে সমস্যার কারণ অনেক সময়ে লুকিয়ে থাকে ফ্যালোপিয়ান টিউবে। তাই কোনও সমস্যা দেখা গেলে শীঘ্র চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

Advertisement

সুনীতা কোলে

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৪:৫৪
Share:

— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

বছর দুয়েক চেষ্টার পরেও মা হতে পারছিলেন না এক তরুণী। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে প্রাথমিক পরীক্ষানিরীক্ষার পরে দেখা যায়, বছর আঠাশের ওই তরুণীর ডিম্বাণু, ডিম্বাশয়, জরায়ু ও হরমোন সংক্রান্ত কোনও সমস্যা নেই। তাঁর ঋতুচক্রও নিয়মিত। পরীক্ষায় তাঁর স্বামীরও কোনও শারীরিক সমস্যা নেই বলে জানা যায়। পরবর্তী পর্যায়ের পরীক্ষায় জানা যায়, গর্ভধারণে সমস্যার আসল কারণ লুকিয়ে রয়েছে ফ্যালোপিয়ান টিউবে। ব্লকেজ রয়েছে সেখানে।

Advertisement

ফ্যালোপিয়ান টিউব কী?

চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ফ্যালোপিয়ান টিউব হল নারীদেহের প্রজননতন্ত্রের একটি অংশ। ডিম্বাশয় থেকে জরায়ু পর্যন্ত প্রসারিত থাকে এক জোড়া টিউব। ডিম্বাশয় থেকে বেরোনো ডিম্বাণু ফ্যালোপিয়ান টিউবের মধ্য দিয়েই পৌঁছয় জরায়ুতে। ফ্যালোপিয়ান টিউবের মধ্যেই শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর নিষেক ঘটে এবং‌ প্রাথমিক পর্যায়ের ভ্রূণ তৈরি হয়। প্রায় পাঁচ দিন ফ্যালোপিয়ান টিউবে থাকার পরে ভ্রূণ প্রোথিত হয় জরায়ুতে। অর্থাৎ ভ্রূণের প্রাথমিক বৃদ্ধিতে ফ্যালোপিয়ান টিউব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটো টিউবেই ব্লকেজ তৈরি হতে পারে।

Advertisement

কেমন সমস্যা এবং কেন?

স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত বললেন, “ফ্যালোপিয়ান টিউবের সমস্যা বলতে মূলত টিউবের মধ্যে ব্লক বা বাধাকেই বোঝানো হয়। অত্যন্ত সরু এই টিউব ব্লক হয়ে যাওয়ার নানা কারণ রয়েছে, যেমন পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজ়িজ় (পিআইডি), সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজ়িজ় (এসটিডি), এন্ডোমেট্রিয়োসিস, কোনও অস্ত্রোপচার ইত্যাদি। কোনও ইনফেকশন বা এসটিডি-র ঠিক চিকিৎসা না হলে তা থেকে পেলভিক ইনফ্লামেটরি ডিজ়িজ় হতে পারে। এর জেরে ফ্যালোপিয়ান টিউবে প্রদাহ বা ইনফ্ল্যামেশন এবং তা থেকে স্কার টিসু তৈরি হয়ে বাধার সৃষ্টি হয়।জরায়ুর ভিতরে যে রক্তজালিকার আবরণ থাকে, এন্ডোমেট্রিয়োসিসের ক্ষেত্রে তা জরায়ুর বাইরের দেওয়ালে তৈরি হয়। ভিতরের ওই আবরণ স্বাভাবিক ভাবে প্রতি মাসে পিরিয়ডসের সময়ে দেহ থেকে বেরিয়ে গেলেও এন্ডোমেট্রিয়োসিসের ক্ষেত্রে তা হয় না। এই আবরণ ফ্যালোপিয়ান টিউবের উপরে বা কাছে তৈরি হলে ইনফেকশন বা স্কার টিসু তৈরি হতে পারে তার জেরেও। আবার এন্ডোমেট্রিয়োসিস বা ফাইব্রয়েডের সমস্যার সমাধানের জন্য অস্ত্রোপচার করলে তার জেরেও তৈরি হতে পারে স্কার টিসু।” এ ছাড়া, ফ্লুইড জমে ফ্যালোপিয়ান টিউব ফুলে যাওয়ার সমস্যাও দেখা যায়। টিউবের মধ্যে বাধা সৃষ্টি হলে ডিম্বাণু বা সদ্য তৈরি ভ্রূণের যাতায়াত বাধাপ্রাপ্ত হয়। চন্দ্রিমা জানাচ্ছেন, গর্ভধারণের সমস্যায় দেখা যায়, ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রেই এর কারণ ফ্যালোপিয়ান টিউবের সমস্যা।

উপসর্গ কী কী?

অনেক ক্ষেত্রেই পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজ়িজ়ের তেমন কোনও লক্ষণ থাকে না। তাই বিষয়টি ধরা পড়তেও সময় লেগে যায়। তবে মাঝেমাঝেই জ্বর, যোনিদ্বার থেকে দুর্গন্ধযুক্ত নিঃসরণ বা তলপেটে ব্যথা হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াই ভাল। শুধু সন্তানধারণের জন্য নয়, সামগ্রিক ভাবে সুস্থ থাকতে এই সব উপসর্গে সাবধান হতে হবে সব মেয়েদেরই।

রোগ নির্ণয় কী ভাবে?

ডা. চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত বললেন, “ফ্যালোপিয়ান টিউবে সমস্যা রয়েছে, তা সন্দেহ করলে কয়েকটি পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। এর মধ্যে রয়েছে, এক্স-রে, আল্ট্রাসোনোগ্রাফি। তাতেও নিশ্চিত না হওয়া গেলে চিকিৎসক এইচএসজি (হিস্টেরোস্যালপিঙ্গোগ্রাফি) করাতে বলতে পারেন। এই পদ্ধতিতে একটি বিশেষ ধরনের রং পাঠানো হয় ফ্যালোপিয়ান টিউবের মধ্য দিয়ে। রং ঠিক মতো অন্য প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছতে পারছে কি না, তা দেখে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব। আরও একটি পদ্ধতি হল এসএইচএস (সোনোহিস্টেরোসালপিঙ্গোগ্রাম)।”

চিকিৎসা কী?

সমস্যার গভীরতা বুঝে চিকিৎসা পদ্ধতি ঠিক করা হয়। কখনও কখনও ওষুধেই সমস্যা চলে যেতে পারে। তা না হলে বেছে নিতে হতে পারে অস্ত্রোপচারের পথ। ল্যাপরোস্কপির মাধ্যমে সরানো হয় টিউবের বাধা। কিন্তু যে কোনও অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রেই ফের নতুন করে সে ক্ষেত্রে স্কার টিসু তৈরির আশঙ্কা থাকে। কোনও কারণে বাধা সরানো সম্ভব না হলে চিকিৎসকেরা সন্তানধারণের জন্য আইভিএফ পদ্ধতির পরামর্শ দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে মায়ের ডিম্বাণু সংগ্রহ করে বাবার শুক্রাণু সঙ্গে নিষেক ঘটিয়ে ভ্রূণ স্থাপন করা হয় মায়ের জরায়ুতে।

চন্দ্রিমার কথায়, “ফ্লুইড জমে টিউব ফুলে ওঠার সমস্যা থাকলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাদ দিতে হতে পারে পুরো টিউবই। কারণ ওই ফুলে ওঠা জায়গা থেকে নিঃসৃত তরলের জেরে জরায়ুতে ভ্রূণ বেড়ে উঠতে পারে না, অর্থাৎ এই ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি হয় আইভিএফ পদ্ধতির পথেও।”

এ ছাড়া, তীব্র প্রদাহের কারণে টিউবে তৈরি হতে পারে অ্যাবসেস। ওষুধে না সারলে সে ক্ষেত্রেও বাদ দিতে হতে পারে টিউব। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এ ক্ষেত্রে নজরে থাকে রোগীর সামগ্রিক সুস্থতার বিষয়টিই।

এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি

ফ্যালোপিয়ান টিউবের বাধার একটি গুরুতর দিক হল এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি। এ ক্ষেত্রে ভ্রূণ জরায়ুতে প্রোথিত না হয়ে রয়ে যায় ফ্যালোপিয়ান টিউবেই। কিন্তু সেখানে ভ্রূণের বেড়ে ওঠার যথেষ্ট জায়গা থাকে না। ফলে সেটি ফেটে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রাণসংশয়ের আশঙ্কা অবধি থাকে বলে জানাচ্ছেন চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত। গর্ভধারণের পরে তলপেটের এক দিকে ব্যথা, মাথা ঘোরা, শারীরিক অসুস্থতার মতো উপসর্গ থাকলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এক বার এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির পরে পরবর্তীকালে গর্ভধারণের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা হওয়ার ভয় বেড়ে যায় অনেকটাই। তাই পরবর্তী প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে রক্তপরীক্ষার মাধ্যমে হরমোনের ওঠানামার দিকটি কড়া নজরে রাখা দরকার। ভ্রূণের বৃদ্ধি হচ্ছে, কিন্তু তার অবস্থান বোঝা যাচ্ছে না, এমন ক্ষেত্রে সতর্ক হবে হবে তখনই।

এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে সন্তান জন্মের কোনও সুযোগ থাকে না। শুরুর দিকে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ভ্রূণ বার করে দেওয়াই একমাত্র উপায়। চিকিৎসকদের পরামর্শ, ফ্যালোপিয়ান টিউবের সমস্যা ধরা পড়লে নিতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ। কোনও মহিলা এই সমস্যা অতিক্রম করে মা হতে চাইলে দেরি না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন