Laxmi Puja Special

ফর্দ মিলিয়ে দশকর্মার দোকানে না কি ফোনের ক্লিকে, লক্ষ্মীপুজোর সামগ্রী এখন কিসে কিনছে বাঙালি?

লক্ষ্মীপুজো মানে তো শুধু প্রতিমা, ফলমুল আর পুরোহিত ঠিক করাই নয়, থাকে আরও বহু কাজ। এক এক পুজোর আলাদা আলাদা আচার। সেই অনুযায়ী পুরোহিতের থেকে দশকর্মার তালিকা নিয়ে দোকানে-দোকানে ঘুরে পরিমাণ মতো জিনিস কেনা রীতিমতো সময়সাপেক্ষ কাজ। সময় বাঁচাতে অনলাইনের যুগে কি পুজোর বাজার ম্লান হয়েছে?

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২৫ ০৯:৫৮
Share:

অনলাইনের যুগে কি দশকর্মা ভান্ডারে ভিড় কমতে শুরু করেছে? গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো, কাজের চাপে সময় নেই বাজার করার। এমন পরিস্থিতি এখন ঘরে ঘরে। তবে তার সমাধানসূত্রও তো এখন হাতের নাগালে! অতি সহজে ফোনে কয়েক ক্লিকেই ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে পুজোর যাবতীয় সামগ্রী। পুজো মানে তো শুধু প্রতিমা, ফলমুল আর পুরোহিত ঠিক করাই নয়, থাকে আরও বহু কাজ। এক এক পুজোর আলাদা আলাদা আচার। সেই অনুযায়ী পুরোহিতের থেকে দশকর্মার তালিকা নিয়ে দোকানে-দোকানে ঘুরে পরিমাণ মতো জিনিস কেনা রীতিমতো সময়সাপেক্ষ কাজ। কোথাও মিলবে কাগজের মালা, তো অন্য এক প্রান্তে মিলবে কাঁচা দুধ, ঘি। কোনও দোকানে পাওয়া যাবে চাঁদমালা, ধূপধুনো, আলপনা, তো কোথাও আবার নাড়ু। ব্যস্ততার মধ্যে সেই ঝক্কি সামলানো সহজ নয় অধিকাংশের কাছেই। তবে যুগ বদলেছে, এখন ঠাকুরমশাইয়ের থেকে ফর্দ আনিয়ে বাড়িতে বসে এক ক্লিকেই সব সামগ্রী দুয়ারে এসে পৌঁছবে মাত্র পনেরো মিনিটে। এত আড়ম্বরের মাঝে কি তা হলে ফিকে হয়ে যাচ্ছে শহরের অলিগলিতে ছড়ানো দশকর্মা ভান্ডারগুলির রোশনাই?

Advertisement

ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং অনলাইন অ্যাপ থেকে লক্ষ্মীপুজোর উপকরণ কিনে ফেলেছেন এ শহরের অনেকেই। পুজোর আগের দিনই দশকর্মা-সহ ফলফলাদি, সময় মতো সবই পৌঁছে গিয়েছে তাঁদের বাড়িতে। যেমন দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা সৃজিতা সরকার জানালেন, ‘‘অফিসশেষে ভিড়ের মধ্যে ঘুরে ঘুরে বাজার করে দেখতাম, পুজোর দিনটাতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এত পরিশ্রম করে বাজার করেও পরে আবার পুরোহিত বলতেন, এটা নেই, ওটা আনা হয়নি। তখন শেষ মুহূর্তে আবার সেই ছুটোছুটি লেগেই থাকত। অনলাইনে কেনাকাটা করলে সেই সমস্যা পোহাতে হয় না।’’

লক্ষ্মী থেকে গণেশ, প্রত্যেক পুজোর নির্দিষ্ট প্যাকেজ রয়েছে। অর্ডার দিলে সঙ্গে মিলছে ফলমূল, মিষ্টিও। আবার বাঙালির পুজোর বাক্সে যেমন পঞ্চশস্য, পঞ্চরত্ন, আসন, অঙ্গুরীয়, মধুপর্কের বাটি, তিরকাঠি, হরিতকি, মাসক্ইলায়ের মতো জিনিস রাখতেই হচ্ছে, তেমনই অবাঙালিরদের পুজোর বাক্সে থাকছে পাঁচ মেওয়া, রৌলি, মৌলি, লবঙ্গ, গিরীগোলা, মজিদের মতো প্রয়োজনীয় উপকরণ। বাঙালির পুজোবাক্সে হোমের উপকরণ—বেলকাঠ থাকছে, অবাঙালির প্যাকেজে থাকছে আমকাঠ।

Advertisement

লক্ষ্মীপুজোর আগে বাজারে চলছে কেনাকাটা।

কাঁকুড়গাছির কর্পোরেশন মার্কেটে কিন্তু লক্ষ্মীপুজোর ভিড় বেশ ভাল মতোই চোখে পড়েছে। বাজারের এক দশকর্মার দোকানের কর্ণধার সজল দাশগুপ্তের মতে, ‘‘প্রতি বারের মতো এ বছরও লক্ষ্মীপুজোর বাজার এখনও পর্যন্ত বেশ ভালই চলছে। এখনও মানুষ পুজোর বাজার দেখেশুনে কিনতেই ভালবাসেন। এই ধরুন চাঁদমালা। লক্ষ্মীপুজো উপলক্ষে আমার দোকানে প্রায় পঞ্চাশ রকমের চাঁদমালা এসেছে। গ্রাহক মিনিট পাঁচেক ভাবনাচিন্তা করে নিজেদের পছন্দের চাঁদমালা বাছাই করছেন। অনলাইনে সে সুযোগ কই? আর অনলাইনে যে সব পুজোসামগ্রীর বাক্স মেলে, তাতে উপকরণ থাকে সীমিত, ঠাকুরমশাইদের প্রয়োজনীয় অর্ধেক উপকরণই সে বাক্সে থাকে না। তাই বছরের পর বছর ধরে দশকর্মা ভান্ডার থেকেই পুজোর সামগ্রী কিনছেন মানুষজন।’’

গড়িয়াহাট বাজারেও লক্ষ্মীপুজোর আগের রাতে দশকর্মার দোকানগুলির সামনে মানুষজনের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। ব্যবসায়ী অরুণ রায় বলেন, ‘‘অনলাইনে বাড়িতে বসে দশকর্মার ফর্দ মিলিয়ে বাজার করা কখনওই সম্ভব নয়। বিভিন্ন অ্যাপে যে পুজোবাক্স বিক্রি হচ্ছে, তাতে গোটাদশেক উপকরণ ভরে বাহারি মোড়কে মুড়িয়ে দেওয়া হয় মাত্র। বাইরে থেকে দেখতে বেশ লাগলেও পুজোর সময় একাধিক উপকরণই হাতের কাছে পাওয়া যায় না। আর দামের কথা তো ছেড়েই দিলাম। মধ্যবিত্ত বাঙালি এখনও দশটা দোকান ঘুরে দরদাম করেই পুজোর জিনিস কিনতে পছন্দ করে। পুজোর আগে বাজারে ভিড়ই সেই কথায় সিলমোহর দিচ্ছে।’’

লক্ষ্মীপুজোর সামগ্রী। —নিজস্ব চিত্র।

স্কুলশিক্ষিকা অনুপমা বন্দ্যোপাধ্যায়। দশ বছর হল তিনি বাড়িতে লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন করছেন। অনুপমা বলেন, ‘‘অনলাইন থেকে জুতো, জামা, বই— সবই কিনি, তবে পুজোর উপকরণটা এখনও বাজারে গিয়েই কিনতে হয়। বিভিন্ন অ্যাপে এখন পুজোর সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে বটে, তবে খোঁজ করে দেখেছি, পুজোর টুকিটাকি জিনিস এখনও সেখানে পাওয়া যায় না। হাতে সময় কম, তাই আগে থেকেই দশকর্মার দোকানে ফোন করে পুজো- সামগ্রীগুলি লিখিয়ে দিই। তাঁরা ফর্দ মিলিয়ে সুন্দর করে গুছিয়ে প্যাকেট করে রাখেন। আমি পুজোর আগের দিন গিয়ে পছন্দের চাঁদমালা, কদম, সাজসজ্জার উপকরণগুলি কিনে নিই। তবে আমার মনে আছে, গত বছর ফর্দ মিলিয়ে সব কিনে আনলেও গঙ্গাজলটা বাদ পড়ে গিয়েছিল। তখন কিন্তু বিপদে পড়ে অনলাইনেই গঙ্গাজল আনাতে হয়েছিল। শেষ মুহূর্তে অনলাইনই সহায় হয়েছিল বটে, তবে পুজোর বাজারটা নিজে হাতে দেখেশুনে করতেই পছন্দ করি এখনও।’’

হাতিবাগান বাজারের ছবিটাও এক। লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন তখন ঘড়িতে সাতটা বাজে। ঘেমেনেয়ে পুজোর বাজারে ব্যস্ত বছর তিরিশের অরিন্দম পাল। বাজারে তাঁকে সঙ্গ দিচ্ছেন তাঁর স্ত্রী দেবারতি পাল। বিয়ের পর এটাই তাঁদের প্রথম লক্ষ্মীপুজো। বাড়িতে বসেও তো পুজো-সামগ্রী কিনে ফেলা যায়, তবে এই ভিড় ঠেলে বাজার করছেন কেন? অরিন্দম বলেন, ‘‘পুজো মানেই তো অনেক আয়োজন। প্রতিমা, দশকর্মার বাজার, ফল, মালা, শাকসব্জি, আরও কত কী! হাতিবাগান বাজারে এলে সবটাই হাতের কাছে পেয়ে যাই। বাবা-মাকেও দেখেছি এখান থেকেই পুজোর বাজার করতে, তাঁদেরই দেখানো পথে আমরাও চলছি। অনলাইনে পুজোর জিনিস পাওয়া গেলেও সেখানে দামটাও কিন্তু সাধারণ বাজারের তুলনায় অনেকটাই বেশি। হ্যাঁ, অনলাইনে কেনাকাটা করলে ঝক্কি কম, তবে পকেটের কথাও ভাবতে হবে তো। তাই কষ্ট হলেও বাজার ঘুরেই পুজোর কেনাকাটা করি।’’

লক্ষ্মীপুজোর আগে দশকর্মা ভান্ডারে চলছে গোছগাছের পর্ব। —নিজস্ব চিত্র।

অনলাইনে পুজোর উপকরণ পাওয়া গেলেও বাঙালি যে এখনও বাজারে গিয়েই বাজার করছেন, তার একটা বড় কারণ হল চড়া দাম। যেমন ধরুন পুজাদুকান ডট কম নামে ওয়েবসাইটে দুর্গাপুজোর সামগ্রী থেকে বিয়ের সামগ্রী, সবই বিক্রি হচ্ছে। দিন পনেরো আগে অর্ডার করলেই সেই সব উপকরণ পৌঁছে যাবে আপনার বাড়িতে। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো সামগ্রী কিট বিক্রি হচ্ছে ১,১৫০ টাকায়। সেই কিটে আপনি পেয়ে যাবেন, নারকেলের ছোবড়া, লাল চেলি, গঙ্গামাটি, গামছা, ধান, চাঁদমালার মতো প্রায় চল্লিশ রকম উপকরণ। শহরের যে কোনও বাজারে গিয়ে সেই উপকরণের ফর্দ মিলিয়ে বাজার করলে ৫০০ টাকারও কম খরচ হবে। বেঙ্গলসোক নামের ওয়েবসাইটেও লক্ষ্মীপুজোর সামগ্রী বাক্স বিক্রি হচ্ছে ১৫০০ টাকায়। অনেকে বলতেই পারেন, আরাম চাইলে দাম তো দিতেই হবে। তবে বাঙালি কিন্তু এখনও ঘেমেনেয়ে থলি ভর্তি করে পুজোর বাজার করতেই অভ্যস্ত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement