রোগ চিহ্নিত হতেই দেরি, বলছে সমীক্ষা

বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধী শিশুর বেড়ে ওঠার পথে সব চেয়ে বড় বাধা হল তা চিহ্নিত না হওয়া। কারণ বিভিন্ন সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে  বাবা-মায়েরাও অনেক সময়েই মেনে নিতে পারেন না যে শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে কিছু সমস্যা রয়েছে।

Advertisement

দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৮ ০১:৪৫
Share:

অটিজম সোসাইটি ওয়েস্ট বেঙ্গলে চলছে বিশেষ শিশু ও তাদের মায়েদের ‌‍প্রশিক্ষণ।— নিজস্ব চিত্র।

শিশুর ‘অন্য রকম’ আচরণ দেখলে কোথায় যেতে হবে, এখনও দিশেহারা এ শহরের অধিকাংশ বাবা-মা। তবে বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতা ধরা পড়লে হাতে গোনা হলেও, ভরসা জোগানোর কিছু জায়গা আছে এ শহরে।

Advertisement

বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধী শিশুর বেড়ে ওঠার পথে সব চেয়ে বড় বাধা হল তা চিহ্নিত না হওয়া। কারণ বিভিন্ন সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাবা-মায়েরাও অনেক সময়েই মেনে নিতে পারেন না যে শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে কিছু সমস্যা রয়েছে। ঠিক সময়ে ঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা হয় না। অনেক অভিভাবকই মনে করেন, সন্তান বড় হলে এমনি ঠিক হয়ে যাবে।

এমন অভিজ্ঞতা চিকিৎসকেদেরও রয়েছে। শিশু মনোবিদ অনির্বাণ রায় যেমন বলেন, ‘‘প্রাথমিক ভাবে বাচ্চার চোখ বা কানের পরীক্ষার কথা বললেই অনেক অভিভাবক তা মানতে পারেন না। ডিজেবিলিটি মেনে নেওয়া তো পরের কথা। অনেকেই মনে করেন, বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’’ তা ছাড়া, মনোবিদের কাছেও পৌঁছন খুব কম সংখ্যক মানুষ। সাধারণত শিশুর কোনও সমস্যা হলেই অভিভাবকেরা প্রথমে যান শিশু চিকিৎসকের কাছে। এ দিকে ইন্টেলেকচুয়াল ডিজেবিলিটির প্রাথমিক লক্ষণ নিয়ে এখনও অনেক চিকিৎসকেরই ধারণা অস্পষ্ট। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঠিক সময়ে ধরাই পড়ে না সমস্য। যেমন শিশু চিকিৎসক অম্লান মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘টিকা দেওয়া বা শিশুর নানা সমস্যা দেখতে গিয়ে এমন খুঁটিনাটি বিষয়ে আমরা নজর দিতে পারি না। সমস্যাটা বুঝতে পারলেও শিশুটিকে কোথায় পাঠাতে হবে, সে বিষয়েও ধোঁয়াশা আছে।’’ শিশু চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষের আবার মত, লক্ষণ বুঝতে গেলে বাচ্চাকে খোলা জায়গায় খেলতে দিয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। এখানে এমন পরিকাঠামোই নেই। তাঁর কথায়, ‘‘বিশেষ শিশুদের জন্য অচেনা পরিবেশ খুব অস্বস্তিকর। তাই চেম্বারে এসে তারা অস্থির হয়ে পড়লে বা কান্নাকাটি শুরু করলে চিকিৎসকের পক্ষে তাকে ঠিক ভাবে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।’’ চিকিৎসকেরাই জানান, এমন অসুবিধে থাকলে সে ব্যাপারে বিশদ জানাতে পারেন ‘ডেভেলপমেন্টাল পেডিয়াট্রিশিয়ান’। শিশুকে তেমন কোনও বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। তবে শহরে তাঁদের সংখ্যা সীমিত। সমস্যা চিহ্নিত হওয়ার আগেই অনেকটা সময় হাত থেকে বেরিয়ে যায় বহু শিশুর।

Advertisement

রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী জানান, সব জেলার আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের বলা হয়েছে, এলাকার প্রতিটি শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠায় কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না, সে দিকে নজর রাখতে। কারও অসঙ্গতি লক্ষ করলে তাকে জেলা হাসপাতালে পাঠানোর নির্দেশ আছে। সেখান থেকেই তাদের এসএসকেএমে রেফার করা হবে। কিন্তু এ তো গেল নিয়মের কথা। কার্যক্ষেত্রে, ডিইআইসি তৈরির পাঁচ বছর পরেও রাজ্যের বহু জায়গাতেই শিশু চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। রাষ্ট্রীয় বাল স্বাস্থ্য কার্যক্রমের উপদেষ্টা অরুণ সিংহ বলেন, ‘‘এসএসকেমের ডিইআইসি আদতে একটি মডেল। এটি দেখেই অন্য রাজ্যগুলিতে একের পর এক ডিইআইসি তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বাংলায় কেন এখনও দ্বিতীয় কেন্দ্র তৈরি হয়নি, তা জানি না। তা তৈরির জন্য সরকারি সাহায্যও চেয়ে পাঠানো হয়নি।’’ অভিযোগ, রাজ্যের একটি মাত্র ডিআইসি নিয়ে সরকারি প্রচার প্রায় কিছুই নেই। কলকাতা ও লাগোয়া শহরতলির বাসিন্দারা তবু প্রাইভেট চিকিৎসার দৌলতে কিছুটা সচেতন হয়েছেন। কিন্তু জেলার মানুষেরা কি আদৌ জানেন সরকারি সুবিধার কথা?

সাড়ে ৫ বছরের ছেলেকে নিয়ে রায়গঞ্জ থেকে এসএসকেএম এসেছেন ফটিক শেখ। ছেলে জিশানের স্পিচ থেরাপি চলছে ডিইআইসি-তে। তিনি বলেন, ‘‘কই, আশা বা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা কিছু জানাননি তো! এক বন্ধুর কাছে শুনে এসেছি।’’ এ অভিজ্ঞতা মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ানের নায়েমা বিবিরও। তাঁর কথায়, ‘‘হন্যে হয়ে ঘুরছিলাম। এক বন্ধু বলল, কলকাতায় যাও, ভাল ডাক্তার পাবে।’’ তিনি এসএসকেএমে এলে শিশু চিকিৎসক রেফার করেন ডিইআইসি-তে। স্বাস্থ্য অধিকর্তা দাবি করেন, ‘‘কলকাতায় বিধানচন্দ্র রায় শিশু হাসপাতাল এবং বাকি সব জেলা হাসপাতালে ডিইআইসি তৈরির পরিকল্পনা আছে। সেগুলি তৈরি হয়ে গেলেই জোরদার প্রচার চালানো হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন