কোলে-পিঠে

দূর হটো বেত, চড়, স্কেল, ছড়ি

পিঠে মার না-পড়লে সন্তান মানুষ হয় না—এই ধারণায় বড় কাটা চিহ্ন দিচ্ছেন একালের মনোবিদ, শিক্ষাবিদেরা। তা নিয়েই লিখেছেন পেরেন্টিং বিশেষজ্ঞ সাবা ইসলামশিশুরা অবাধ্য হলে বা অভিভাবকের মনের মতো কাজ না-করলে, খেতে না-চাইলে বা পরীক্ষায় নম্বর কম পেলে অনেক অভিভাবক সন্তানকে মারেন। এর পরিণতি ভয়ঙ্কর হতে পারে। এমন অনেক অভিভাবককে আছেন যাঁরা শিক্ষকদেরও সন্তানকে মেরে শাসন করতে বলেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:১৮
Share:

ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

স্কুলে পন্ডিতমশাইয়ের ছড়ির মার একসময়ে ছিল বাধ্যতামূলক। সেই সঙ্গে গাঁট্টা, হাতের দুই আঙুলের ফাঁকে পেন্সিল গুঁজে চাপ দেওয়া, কান মলা, থাপ্পড়, ডাস্টার ছুড়ে মারার মতো অনেক শাস্তিই ছিল। অভিভাবকেরাও মনে করতেন, এ সব না হলে বাচ্চা মানুষ হবে না। কিন্তু ধারণাটা এ কালে একেবারে উল্টে গিয়েছে। এতে শিশুমনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বুঝেই স্কুলে মার এখন নিষিদ্ধ। কিন্তু তাতে ছোটদের মারা বা মার খাওয়া থামেনি। বাড়িতে হামেশাই শাসনের নামে তাদের গায়ে হাত দেওয়া হয়। ছোটরা প্রতিবাদ করতে পারে না, পাল্টা মারতেও পারে না, তাই খুব সহজে তাদের নিগ্রহ করা যায়।

Advertisement

শিশুরা অবাধ্য হলে বা অভিভাবকের মনের মতো কাজ না-করলে, খেতে না-চাইলে বা পরীক্ষায় নম্বর কম পেলে অনেক অভিভাবক সন্তানকে মারেন। এর পরিণতি ভয়ঙ্কর হতে পারে। এমন অনেক অভিভাবককে আছেন যাঁরা শিক্ষকদেরও সন্তানকে মেরে শাসন করতে বলেন। এতে ভয়, লজ্জা, ঘৃণা, অশ্রদ্ধা আর অপমানবোধ নিয়ে বেড়ে ওঠে সেই সব শিশুরা। শারীরিক শাস্তি দিয়ে কোনও মানুষের কাছ থেকে কখনওই ভাল কিছু আশা করা যায় না। অনেকের আত্মবিশ্বাস কমে যায়। সে গুটিয়ে যায়, ভয় পেয়ে থাকে। অনেকে আবার মরিয়া হয়ে পাল্টা রুক্ষ্ম, বদমেজাজি, মারমুখী হয়ে ওঠে।

দৈহিক শাস্তির নেতিবাচক প্রভাব পড়ে শিশু মনে। শিশুর আত্মমর্যাদাবোধ ও অহংকে তা আঘাত করে ও শিশুকে পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন ও আক্রণাত্মক করে তোলা হয়। এতে অনেক শিশু মনে করতে থাকে হিংসা ও প্রতিশোধই সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ। শারীরিক অত্যাচারে ভোগা শিশু বড় হয়ে নিজের শিশু, স্ত্রী-স্বামী বা বন্ধুদের উপর অত্যাচার করে।

Advertisement

দৈহিক শাস্তি দিয়ে কাউকে অনুপ্রাণিত বা শৃঙ্খলিত করা যায় না। শিশুকে নিয়মানুবর্তিতা শেখানোর মানে এই নয় যে, তার বিকশিত হওয়ার অধিকার আমরা ছিনিয়ে নেব। শিশুর শারীরিক শাস্তি কোনও ধর্ম বা আইনে অনুমোদন করে না। কোনও ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারছেন না বলে কোনও ব্যক্তি শিশুকে মারার বা শারীরিক ভাবে আঘাত করার অধিকার পেতে পারেন না। এটা অভিভাবকদের অক্ষমতা।

শিশুর আচরণে পিতা-মাতার রাগ হতেই পারে কিন্তু তা যেন নিয়ন্ত্রিত হয়। পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে ঠান্ডা মাথায়। শিশুর অনুভূতিকে মূল্য দেওয়া অবশ্য কর্তব্য। শিশুর প্রতি এমন ব্যবহার করতে হবে যাতে তারা অনুভব করে যে, তাদেরকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। হ্যাঁ-সূচক বাক্য প্রয়োগ ও ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে শিশুকে শৃঙ্খলাপরায়ন করতে হবে। নিজেদের নেতিবাচক অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

শিশুকে ভাল ও মন্দের মধ্যে পার্থক্যগুলো আগে বোঝাতে এবং সে সব বিষয়ে তাদের মতামত বিবেচনা করতে হবে। তার নিজস্ব ব্যক্তিত্ব এবং রুচিবোধ তৈরি করতে হবে। তার জানার আগ্রহ ও শিক্ষাকে আনন্দময় করে তোলা জরুরি। সন্তানকে অসম প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেবেন না। অতিরিক্ত শাসন ও শারীরিক শাস্তির মাধ্যমে তার শৈশব ও কৈশোরের আনন্দময় সময়টুকু কেড়ে নেবেন না। প্রত্যেকটি শিশুর সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। তাদের পৃথিবী হোক ভয়হীন ও বাধাহীন।

মেরে কাউকে কিছু শেখানো যায় না। শিশুকে শৃঙ্খলায় আনতে হবে প্রথম থেকে। তার জন্য তার বন্ধু হন এবং তার মনোভাব বুঝুন। শাসন নিশ্চয় করবেন তবে তার থেকেও জরুরি হল শিশুকে আদর করা। সে যেন কখনও মনে না-করে যে, মা-বাবা তাকে ভালোবাসেন না। মনে রাখবেন, কোনও কিছুই অতিরিক্ত ভাল নয়। না আদর, না শাসন। দু’টোর মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হবে। শিশুকে শাসনের আগে বড়দের আগে দেখে নিতে হবে যে, তাঁদের নিজেদের ব্যবহারে কোনও পরিবর্তন আনা প্রয়োজন কি না।

সন্তানকে বাড়ির বিভিন্ন কাজকর্মে আগ্রহী করুন। ওর মতামত নিন। এতে ও নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে এবং আপনার কথা শুনতে আপত্তি করবে না। সন্তানকে শাসন করার সময় মোটিভেট করা খুব জরুরি। রেগে গিয়ে শিশুকে জোরে ঝাঁকুনি দিলেও তার মনে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। শিশু মনে বড়দের বিরুদ্ধে ক্রোধ ও ঘৃণা জন্মাতে পারে।

তাদের মনের যা কিছু সুন্দর ও কোমল তা হারিয়ে যায়। সবকিছুর বিরুদ্ধে বিতৃষ্ণা জন্মায়। কিশোর-কিশোরী অস্বাভাবিক আচরণ করতে পারে। তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা আসতে পারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন