বয়স ধরে রাখার ফাঁদে পা দিয়ে মুখ পুড়িয়েছি! নামী ব্র্যান্ডের ক্রিম-সিরামের কি কম ব্যারাম?

বয়স ধরে রাখার ফাঁদে পড়ে ‘অ্যান্টিএজিং ক্রিম’ কেনা। কথা ছিল ১৫ দিনেই মিলবে ফল। কিন্তু সেই ফলভোগের অভিজ্ঞতায় বলিরেখা বাড়লই।

Advertisement

সম্পিতা দাস

শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:৫৯
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

তিরিশ পেরোলেই যেন একটা অদৃশ্য ঘড়ির টিকটক টিকটক শব্দ শোনা যায়। আমার এখন ৩৩। এক রবিবাসরীয় দুপুরে মনে হল, মুখে বলিরেখা পড়ছে। ভয় ভয় করল। সেই চিন্তা থেকেই একবারে পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে একটি শপিং মলের বহুজাতিক প্রসাধানী দোকান থেকে কিনে ফেললাম একগুচ্ছ জিনিস। যার মধ্যে ছিল একটি টোনার, সিরাম, নাইট ক্রিম ও ডে ক্রিম। ঠিক করে ফেললাম, রোজ নিষ্ঠার সঙ্গে চলবে আমার রূপ-রুটিন। বয়স তো ধরে রাখতেই হবে!

Advertisement

কিন্তু রূপ ধরে রাখার ফাঁদে পা দিয়েই যে আসলে রূপ খোয়ানোর জোগাড় হবে, তা কে জানত!

ছবি: সংগৃহীত।

চারদিকে কম তো শুনি না। সহকর্মী থেকে বন্ধুবান্ধব, প্রায় সকলেই আজকাল বহু ধরনের সিরাম আর ক্রিম মাখেন। আমার সে ভাবে কখনও ব্যবহার করে দেখা হয়নি। এক এক জন এক এক রকমের সিরাম কেনার পরামর্শ দেন। কিন্তু কোনটা মাখলে কী লাভ হবে, তা তো বুঝি না!

Advertisement

এ দিকে, আমার আবার উঠল বাই তো কটক যাই স্বভাব। যখন যা ভাবি, সঙ্গে সঙ্গে সেটাই করে ফেলি। এ সব বিষয়ে অন্যের মতামত নয়, নিজের মনের ইচ্ছেকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছি। আমার মুখে বলিরেখা নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা বরকে জানাতেই ঠোঁট উল্টে বলেছিল, ‘‘কই কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না!’’ কিন্তু যখন আমার মাথায় একটা চিন্তা এসেছে, সেটা তো সহজে যাবে না। আমার মুখ-চোখ দেখে শেষে বর বলে ‘‘কোথায় কখন যেতে হবে পুরো প্যাকেজ কিনতে, বলো!’’ ফলে বয়স ধরে রাখার প্রকল্পে জুড়ে গেলেন আমার স্বামীও।

এমনিতে তো মানুষের জীবন প্রায় অতিষ্ঠ করেই রেখেছে ফেসবুকের অ্যালগরিদ্‌ম। এক রাতে অফিস থেকে ফেরার পথে ভুল করে ইউটিউবে ৫ সেকেন্ডের জন্য ত্বকের জেল্লা ধরে রাখার একটা ভিডিয়ো দেখা শুরু করেছিলাম মাত্র। ব্যাস, এ বার ফেসবুক থেকে ইনস্টাগ্রাম, সর্বত্র আমার ফিড ভরে গেল ত্বকের জেল্লা বাড়ানো কিংবা ওজন কমানোর সহজ উপায়ের ভিডিয়ো আর পডকাস্টে। মোটামুটি পাঁচ দিন ধরে সে সবও আমার মগজধোলাই করল। ফলে ফাঁদে পা দিয়ে ফেললাম আরও সহজে।

আমি নিজে কিন্তু মনে করি, আমাদের ত্বকের বলিরেখা আসলে এক একটা অভিজ্ঞতার ছাপ। তবু নিজের হঠকারিতাই যেন টেনে নিয়ে গেল এক মরীচিকার দিকে, যেখানে শুধুই ক্রিম, সিরাম, লোশনের ভিড়। বেশ কিছু পডকাস্ট দেখে আমি তত দিনে বুঝেছি যে, ত্বকের কোলাজেন ও নায়াসিনামাইডের প্রয়োজন রয়েছে। এই জ্ঞানের ভান্ডার নিয়ে বাড়িতে বসে থাকলে তো হয় না, কিছু ব্যবস্থা যে করতেই হবে।

ভাবলাম রূপচর্চার বিষয়ে বেশি জানি না তো কী আছে, জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি। তাই দু’জনে এক দিন বেরিয়ে পড়লাম। সল্টলেকের একটি শপিং মলে পৌঁছোলাম। সেখানে নানা জিনিসের সম্ভার। হরেক ব্র্যান্ডের জিনিসের দোকান। যে দোকানে আমরা ঢুকলাম, সেখানকার কর্মীরা বললেন কী কী নিলে ত্বক ভাল থাকবে। আমিও বাধ্য ছাত্রীর মতো কথা শুনলাম তাঁদের। নিজে আর কী করে জানব, কোন সিরামে কী হয়। প্রথম বার কিনছি। ফলে কাউকে ভরসা করতেই হবে। তা ছাড়া, নামী দোকানের কর্মীরা পরিচিত সংস্থার প্রসাধনী যখন দেখাচ্ছেন, তখন ভালই হবে হয়তো!

ছবি: সংগৃহীত।

কিন্তু এটাই যে ফাঁদ। এ সব জায়গা ঢুকলে যে কর্মীরা নানা কিছু জোর করে গছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, এ সব আমি জানি। কিন্তু ওই যে, ‘লোভে পাপ আর পাপে…।’

দোকানে গিয়ে নিজের প্রয়োজনীয়তা ও হালকা উদ্বেগের কথা জানাতেই তাঁরা আমাকে বিশাল বড়লোক ভেবে বসলেন। শুরু হল একের পর এক ‘অ্যান্টিএজিং ক্রিম’ দেখানো। ক্রিম তো আবার একা নয়, তার সঙ্গে নাকি থাকতে হবে টোনার ও সিরাম। একটি কিনলে বাকি পুরো প্যাকেজটিই নাকি নিজের গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে কিনতে হবে।

এমন ভাবে ‘ম্যাম, ম্যাম’ বলে আমার মুখের রেখা নিয়ে চিন্তাপ্রকাশ করতে থাকলেন সে দোকানের কর্মীরা, যেন আর কয়েক দিন দেরি করলেই বলিরেখা মুখের চেহারাই বদলে দেবে। আমার মতো সাধারণ চাকরিজীবী মানুষ না তো রেখা হওয়ার স্বপ্ন দেখে, না তো আলিয়ার মতো ত্বকের ঔজ্জ্বল্য ধরে রাখার চেষ্টা করার সুযোগ পায়। কিন্তু শখের দাম তো লাখ টাকা। আর তার সঙ্গে যদি জুড়ে দেওয়া হয় ভয়, তবে তো কথাই নেই।

যখন দোকানে এক এক করে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকার ক্রিম দেখানো হচ্ছে, সেগুলো ছুঁলেই যেন ছেঁকা লেগে যাবে মনে হচ্ছে। চক্ষু বিস্ফারিত হয়ে গিয়েছে আর মন বলছে ‘সম্পিতা আজ তুই ফেঁসে গিয়েছিস।’ মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে, শখ যতই হোক বাজেট বলে একটা বস্তু আছে তো! ৫০ হাজার টাকার ক্রিম মুখে মাখব, সেটা তো ভাবতেই পারি না। শুধু একটা ক্রিম নয়, সেটার সঙ্গে নিতে হবে একটা টোনার সঙ্গে একটা সিরাম। এই জিনিস কেনার টাকার ব্যাঙ্কে এফডি (ফিক্সড ডিপোজ়িট) হয়ে যাবে। ফলে বুকে পাথর রেখে জানিয়ে দিলাম, ‘‘আমার দরকার নেই।’’

এ সব বাণিজ্যিক কায়দা এড়িয়ে মনে মনে ভাবলাম, ‘যাক বাবা, এ বারের মতো বেঁচে গেলাম।’ তখনই পিছুডাক, ‘ম্যাম, আমাদের ইকোনমিক রেঞ্জও আছে’। মানে ক্রেতার পকেট বুঝে বিক্রি। এ বার সুসজ্জিত এক পুরুষ একটি বাজারচলতি ব্র্যান্ডের বয়সপ্রতিরোধক ক্রিম দেখাতে শুরু করলেন। এই ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনের মুখ ঐশ্বর্যা রাই বচ্চন, আলিয়া ভট্টেরা। যদিও তাঁরা কেবল মুখই। নিজেদের মুখে এ সব তোলেন না নিশ্চয়ই। কিন্তু ওই মনে মনে সাধ যে আমারও ষোলো আনা। আবার বলতে পারেন সাধ্যের মধ্যে পয়সা খরচের ব্যামোও।

অনেক কিছু বুঝিয়ে আমাকে একটি টোনার, একটি সিরাম ও একটি নাইট ক্রিম বিক্রি করতে সফল হলেন ওঁরা। যার মধ্যে স্যালিসেলিক অ্যাসিড, প্রোঅ্যাক্সিলেন ও এলএইচএ নানা রকেমর উপাদান রয়েছে নাকি। পুরো জিনিসটা যখন হচ্ছে, আমার বর খালি মাঝেমাঝেই আমার দিকে তাকাচ্ছে আর ফিক ফিক করে হাসছে।

সে সব হাসির তোয়াক্কা না করেই বিল হল ৫০০০ টাকা। শুনেই কেমন শরীর খারাপ লাগল। মনের কথা বুঝে বর একটু এগিয়ে আসতেই আমি বললাম, ভাগাভাগি করে টাকা দেব। তুমিও মাখবে, আমিও মাখব। সে-ও শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘‘আচ্ছা বেশ।’’

এ বার এই ক্রিম বাড়িতে এনে শুরু হল রূপচর্চা। অফিসে বেরোনোর আগে স্নান সেরেই টোনার, তার পর খানিক বিরতি নিয়ে সিরাম, তার পর ডে ক্রিম। দোকান থেকে বলে দিয়েছিল সারা দিনে দু’বার করে সব। এই নিয়ম মেনে চললে নাকি ১৫ দিনেই ফল পাওয়া যাবে। অফিসে যাওয়ার আগে ও ফেরার পর একই পদ্ধতি রাতে শুধু ডে ক্রিমের বদলে, নাইট ক্রিম।

বলে রাখি, এই পুরো জিনিসটা কিনেছিলাম সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। কারণ, শেষের দিকে পুজো। তার আগে জেল্লা ফেরাতে হবে। নিজে মাখছি, মাঝেমধ্যে বরকেও বলছি মাখতে। প্রথমে তার খুব একটা উৎসাহ দেখতে না পেয়ে বেশি জোরাজুরি করিনি। এ ভাবেই প্রায় ২০ দিন পার। পুজোর ঠিক সাত দিন বাকি যখন, তখন টের পেলাম বিপদটা। হঠাৎ আমার মুখ ভরে গেল ছোট ছোট দানায়।

সেই নিয়ে অফিস যেতেই মুখে জ্বালা শুরু হল। তার পরও গোটা এক দিন কাটালাম। তার পরের দিন থেকে দেখি গালে কালো ছোপ ছোপ, পুড়ে গেলে ঠিক যেমন হয়। সঙ্গে সঙ্গে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে ছুটলাম। তিনি যাবতীয় প্রসাধনীর এই বাজারচলতি ক্রিম মাখার উপর নিষেধাজ্ঞা দিলেন। তার পর ওষুধ দেওয়া কিছু ক্রিম ও ফেসওয়াশ লিখে দিলেন। সে সব নিয়ে এ বার আরও চার হাজার টাকা খরচ হল বটে। তবে তাতেই ধীরে ধীরে সুস্থ হলাম।

এখন সব বাদ দিয়ে চিকিৎসকের দেওয়া ক্রিমই ব্যবহার করছি। আর ড্রেসিং টেবিলে লাল কাচের কৌটটে সাজানো রয়েছে মহার্ঘ্য সেই সব প্রসাধনী। সারা দিন অফিসে খাটাখাটনির পরে যখন বাড়ি ফিরে কষ্টে উপার্জন করা অর্থ ব্যয় করে কেনা সে সব কৌটোর দিকে চোখ যায়, জ্বালা যেন আরও বাড়ে। এক দিন সে জ্বালা সহ্য না করতে পেরে বরকে বললাম, ‘‘তুমি মাখো না ক্রিম আর সিরামগুলো। তোমার ত্বকের ঔজ্জ্বল্য থাকবে, বলিরেখা দূর হবে।’’ তার সটান জবাব, ‘‘থাক না, আমি আমার বলিরেখাদের নিয়ে ভালই আছি। এদের নিয়ে আর টানাটানি কী দরকার!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement