Life style news

দেখা হলেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দুর্গাপুরের গল্প শুনতে চাইতেন সুবোধকাকু

পরবাস আর একাকিত্ববোধ, এই দুই জিনিসকে আমি এক মালায় গেঁথে নিতে অপারগ। পরবাস জীবনের পথ চলার এক ছন্দ, অন্য দিকে একাকিত্ববোধ মনের এক অনিয়ত উচ্ছৃঙ্খল বিহ্বলতা।

Advertisement

বিশ্বজিত সেন

শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৮ ১৭:৪৪
Share:

অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী

একাকিত্বের অভিজ্ঞতার কথা ভাবতে গিয়ে প্রথমেই মনে পড়ে গেল আমার সেই যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে সদ্য পাশ করে বেরিয়ে আসা দিনগুলোর কথা। একটা চাকরি পেয়েছি কলকাতায়। বাড়ি দুর্গাপুরে। কলকাতায় একটা থাকার জায়গা খুঁজে নিতে হবে। কিন্ত কোথায় পাব তারে? আশির দশকে কলকাতায় সদ্য গোঁফ ওঠা, উঠতি বয়সী, চাকরি করা ছোকরাদের ভাড়া বাড়ি খুঁজে পাওয়া ছিল ভীষণ এক কঠিন ব্যাপার। আমরা ছিলাম সামাজিক অবমূল্যায়নের উজ্জ্বলতম উদাহরণ। মেসবাড়ি ঠিক আছে। কিন্ত পুরো একটা বাড়ি ভাড়া— একেবারেই নয়!

Advertisement

কোনও রকমে একটা ছোট ঘর জোগাড় করেছিলাম যাদবপুরের এইটবি মোড়ের কাছে। সকালে বেঙ্গল ল্যাম্প বাসস্ট্যান্ডের মোড়ে ঝুপড়িতে ‘ব্রেকফাস্ট’। রাতে সে রকমই আর এক ঝুপড়িতে ‘ডিনার’। আর শেষে যাদবপুর মোড়ের কাছে দোতলা একটা বাড়ির একতলায় পেছনের দিকে সবচেয়ে বাজে মশা ভর্তি ঘরটাতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া। বাড়ির চার পাশে লোকজন। জীবনের শব্দ শুনতে পাই সারা দিন আর রাত ধরে। অথচ, তার মধ্যে ওই স্যাঁতস্যাতে মশাভর্তি ঘরটাতে আমি যেন সম্পূর্ণ একা। নিস্তব্ধ হিমশীতল একা। যাদবপুরের বন্ধুরা দুম করে হঠাৎ হারিয়ে গেছে সবাই। চাকরি নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। চারপাশে যদিও পরিচিত মুখ আছে। তবু কথা বলার বন্ধু নেই। লোডশেডিংয়ের সন্ধেয় গরমে ঘামতে ঘামতে মশার ভয়ে জানলা বন্ধ করে ঘরটার মধ্যে একা বসে থাকতাম, আর ভাবতাম, এই কি তা হলে আমার জীবন কালীদা? হতাশায় ভরে যেত মন। মনে হত ভালবাসার দাঁড়িপাল্লায় ভীষণ গোঁজামিল হয়ে গেছে আমার ক্ষেত্রে। রাগ হত, ভীষণ অভিমান হত। তার পর, কে জানে, হয়তো সেই রাগ হতাশা আর একাকিত্বের কষ্টিপাথরেই জীবনের বেঁচে থাকার বাসনাটাকে আর একটু ঝকঝকে করে নিতে পেরেছিলাম। পাড়ি দিয়েছিলাম মার্কিন মুল্লুকে, একত্রিশ বছর আগে।

এ দেশে এসে, এ দেশের জীবনযাত্রায় নিজেকে মানিয়ে নিতে নিতে অনেক কিছুই জেনেছি। উপলব্ধি করেছি একাকী থাকা আর একাকিত্বের অবসাদ, এই দুটোর মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। ব্যক্তি স্বাধীনতা, উপার্জন ক্ষমতা, ইত্যাদির কারণে এ দেশে একাকী বসবাস করা জীবনযাপনের স্বাভাবিক এক রীতি। এ দেশের কমবয়সী তরুণ-তরুণীরা অনেক আগে থেকেই নিজেদের তৈরি করে নেয় একাকী থাকার জন্য। ছুটির দিনে সারাটা দিন বাড়ি পরিষ্কার করে, নিজের প্রিয় খাবার রেঁধে এবং তা দিয়ে তারিফ করে একা একা ডিনার সেরে ছেলেটি অথবা মেয়েটি তার অ্যাপার্টমেন্টের ব্যালকনিতে আরামকেদারায় বসে একা একা গল্পের বই পড়তে পারে, সূর্যাস্তের শেষ রোশনীর আলো উপভোগ করতে করতে। একাকী থাকার মধ্য দিয়ে সে তার সামাজিক অবস্থান এবং আত্মবিশ্বাসকে আরও সুদৃঢ় করে নেয়। হাত-পা ছড়িয়ে ‘আমার কী হবে গো’ ভেবে ভেঙে পড়ে না।

Advertisement

আরও পড়ুন: শুধু নিজের জন্য যে বাঁচে, সে-ই একা

আরও দেখেছি মেরিল্যান্ডে আমাদের সবার প্রিয় দিদি ইভাদিকে। দু’মাস হল ইভাদি চলে গেলেন ব্রহ্মাণ্ডের এই কোণটি ছেড়ে। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি এই দেশে ছিলেন। সংসার করেছেন, চাকরি জীবনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সঙ্গে সঙ্গে। এক সময় স্বামী চলে গেছেন পরপারে, প্রায় পঁচিশ বছর আগে। সন্তানেরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন নিজের নিজের সংসার নিয়ে। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে ইভাদি একাই থেকেছেন। তবে হতাশায় ভেঙে প়ড়ে নয়। আশি বছর বয়সেও জাগুয়ার গাড়ি চালিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে- নিজের বাড়িতে একা একা বাস করে। কী করেননি ইভাদি? স্থানীয় বাঙালি অ্যাসোসিয়েশন ‘সংস্কৃতি’র প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মেরিল্যান্ডের কালীবাড়ি এবং বেদান্ত সেন্টারে দিনে পর দিন শ্রমদান করেছেন। দেশ থেকে আসা কমবয়সী নতুন বাঙালি মহিলাদের ইভাদি ছিলেন লোকাল গার্জিয়ান। জীবনের সায়াহ্নে বছরগুলোতেও ইভাদি নিয়মিত ভাবে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করে গেছেন এ দেশের বহু সেবা প্রতিষ্ঠানে। ইভাদির কাছ থেকে আমরা শিখেছি, জীবনকে কী ভাবে গুছিয়ে নিতে হয়, দাপটের সঙ্গে লড়াই করে যেতে হয় প্রতিবন্ধকতার মাঝে।

আরও পড়ুন: এই একা হওয়া আমাদের প্রার্থিত ছিল না তো!

আমাদের আমেরিকার বাঙালি অভিবাসীদের দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা একা থাকার ব্যাপারে যথেষ্ট পারদর্শী হয়ে উঠেছে। কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই সমর্থ হয়ে উঠতে পারেননি প্রথম প্রজন্মের আগের প্রজন্ম। অর্থাৎ, মা-বাবারা— যাঁরা অভিবাসন নিয়ে এসে এই দেশেই স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন ছেলেমেয়ের সঙ্গে। আমার বাবার এক বন্ধু এই ভাবেই চলে এসেছিলেন ছেলের কাছে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও। ছোটবেলায় দুর্গাপুরে আমাদের পাড়ার এই সুবোধকাকু সারা দিন পাড়া মাতিয়ে রাখতেন তাঁর অনাবিল স্নেহ আর ভালবাসা দিয়ে। প্রায়ই বাড়িতে আসতেন আমার বাবার সঙ্গে গল্প করতে, আমাদের সঙ্গেও মজার মজার গল্প করতেন। তার পর এক দিন, পঁচাত্তর বছর বয়সে, সুবোধকাকুর ছেলে তাঁকে পাকাপাকি ভাবে নিয়ে এলেন এই দেশে। আর আসার সঙ্গে সঙ্গে পঁচাত্তর বছর বয়সের সুবোধকাকুর উপর অঘোষিত প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে গেল এই দেশে থাকার আদব কায়দা শেখানোর। কিন্তু সেও কি সম্ভব! জীবন-সূর্যাস্তের ঘাটে দাঁড়িয়ে মন যখন অন্য পাড়ের দিকে তাকিয়ে তখন কি আর হাঁটা যায় ভোরের শিশির ভেজা ঘাসে? দেখা হলে সুবোধকাকু বলতেন, ‘‘আসলে জানিস, আমি এখানে যেন এক রাজবন্দি।’’ জানতাম তো সবই— চাকরি করা ছেলে-বৌয়ের বাড়িতে সারা দিনের নিঃসঙ্গতা-বেড়ানো মানে সপ্তাহান্তে ছেলে-বৌয়ের সঙ্গে তাদের বাঙালি বন্ধুদের বাড়িতে পার্টিতে যাওয়া। সেখানে অনেক কমবয়সী লোকজনের মাঝে আবার অন্য এক ধরনের নিঃসঙ্গতা। প্রায় কুড়ি বছর বেঁচে ছিলেন সুবোধকাকু। শারীরিক কারণে ভারতবর্ষে বেড়াতে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অনেক দিন। দেখা হলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দুর্গাপুরের গল্প শুনতে চাইতেন। জানতে চাইতেন, ওনার বন্ধুদের মধ্যে কে কে মারা গেছেন সেই বছর। প্রাসাদোপম বাড়ির আয়েশের মধ্যে থেকে নিঃসঙ্গ সুবোধকাকু সখ্য খুঁজতেন শেষ খেয়া পারাপারের।

তবুও পরবাস আর একাকিত্ববোধ, এই দুই জিনিসকে আমি এক মালায় গেঁথে নিতে অপারগ। পরবাস জীবনের পথ চলার এক ছন্দ, অন্য দিকে একাকিত্ববোধ মনের এক অনিয়ত উচ্ছৃঙ্খল বিহ্বলতা। কলকাতার আকাশ ভরা কোলাহলের মধ্যেও যেমন একাকিত্বের নিস্তব্ধতা মনকে ঝিমিয়ে দিতে পারে, তেমনই আমেরিকার নির্জন শান্ত শহরের উপকণ্ঠে একাকী বসবাস করেও নিয়ে আসা যায় বেঁচে থাকার উদ্দীপনা- কল্পনার কোলাহল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন