শহরের এক বুটিকে চলছে বিকিকিনি। —নিজস্ব চিত্র।
ছাপোষা গৃহস্থ বাড়ির নিতান্তই সাদামাঠা একটা ঘর। বৈশিষ্ট্য বলতে ঘরের এক দিকে দেওয়াল জোড়া একটা র্যাক শাড়ি-জামাকাপড়ে ঠাসা। সিনথেটিকের কার্পেট পাতা ঘরের মেঝেতে ছড়ানো শাড়ি-কুর্তি-চুড়িদার-পাঞ্জাবির রকমারি সংগ্রহ।
নাম তার বুটিক।
কলকাতার সীমানা ছাড়িয়ে এ বার মফস্সল শহরগুলোতেও বুটিকের ছোঁয়া। নামজাদা দোকানগুলোকে টেক্কা দিয়ে দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যা গড়িয়ে উপচে পড়ছে ভিড়। কেনাকাটার ফাঁকেই চলছে মেয়েমহলের জমাটি আড্ডা। কোনওটা বড় রাস্তার ধারে তো কোনওটা তস্য গলির মধ্যে। সে যাই হোক, রীতিমতো নিশব্দে ওরা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে প্রথাগত পোশাক ব্যবসাকে। ঝাঁ চকচকে শো-রুম নেই। দেওয়াল জোড়া আয়না লাগানো চেঞ্জ রুমই বা কোথায়! বাহারি বিজ্ঞাপনের নজরকাড়া চটকও উধাও। এমনকী শাড়ি বা অনান্য পোশাকের বিরাট সম্ভারও নেই। এক কথায় চেনাছকের ব্যবসা-বানিজ্যের অনেক কিছুই অমিল। তবু ‘বুটিক’ নামের এই ঘরোয়া বিপণন কেন্দ্রগুলি ক্রমশ মফস্সলের মহিলা ক্রেতাদের পছন্দের ঠিকানা হয়ে উঠছে।
কিন্তু বড় বড় বিপণীতে বান্ডিল বান্ডিল শাড়ি দেখেও যাঁদের মন ভরে না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা শাড়ি ঘাঁটার পরে ‘ঠিক পছন্দ হল না’ বলে সটান দোকান থেকে বেড়িয়ে আসেন যাঁরা, তাঁরা কী ভাবে মজেছেন ওই সব স্বল্প পুঁজির ছোট ছোট বুটিকে?
উত্তরে বাইশ থেকে বাহান্নর ক্রেতারা একবাক্যে জানাচ্ছেন— ‘‘বুটিকের শাড়ি মানে এমন একটা শাড়ি, যেটা একান্তই আমার নিজস্ব। আরও কারও কাছে যে শাড়ি নেই।’’ পুজো মণ্ডপে আর পাঁচজনের থেকে আলাদা হওয়ার টানেই কলকাতা থেকে অনেক দূরের মফস্সলের বুটিকেও গুটি গুটি বাড়ছে ভিড়।
যার সার্বিক ফল, নবদ্বীপ শহরেও নয় নয় করে হাফডজনেরও বেশি বুটিক রমরমিয়ে চলছে।
অনেক দিন ধরে নবদ্বীপে বুটিক চালাচ্ছেন পাঁপড়ি মণ্ডল। নিজেই ডিজাইনার। বললেন, ‘‘বড় দোকান বা বাণিজ্যের প্রথাগত ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের কোনও তুলনাই হয় না। ভাবনা থেকে দৃষ্টিভঙ্গি সবেতেই বড় দোকানের সঙ্গে আমাদের মতো বুটিকের বিস্তর ফারাক। স্বল্পপুঁজিতে কেবলমাত্র নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তির সঙ্গে অস্বাভাবিক পরিশ্রমের ফসল এক-একটি বুটিক।’’
প্রায় একই কথা বলেন টুম্পা বসু। বছর চারেক হল বুটিক চালাচ্ছেন তিনি। শাড়ি নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষামূলক নকশা তিনি স্কুল জীবন থেকেই করে আসছেন। কিন্তু তখন সেটা ছিল নিতান্তই শখের। তাঁর কথায়, ‘‘বুটিকের শাড়ি যাঁরা কিনতে আসেন, তাঁরা এমন কিছু প্রত্যাশা করেন, যা সাধারণ দোকানে মিলবে না।’’ কী রকম? তিনি বলেন, ‘‘কোনও একটা বিশেষ ডিজাইন ক্রেতা নিজেই হয়তো দিয়ে গেলেন। আমরা সেই মতো শাড়ি তৈরি করে দিলাম। ফলে পুজোর দিনে ওটা ভীষণ ভাবে তাঁর শাড়ি। এই ব্যাপারটা এখন মফস্সলের মেয়েদের ভীষণ টানছে। ফলে ক্রমশ ভিড় বাড়ছে বুটিকে।’’
আর এক বুটিকের মালকিন মহিমা গোস্বামী সাফ জানান, অনেক টাকাপয়সা ঢেলে দোকান করার ক্ষমতা তাঁর নেই। সীমিত পুঁজি সম্বল করে সারা রাজ্য ঢুঁড়ে খুঁজে আনা হয় ন্যায্য দামের মধ্যে অনন্য জিনিসটি। ‘‘এ জন্য পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-বীরভূম-মুর্শিদাবাদ যেমন ছুটে যাই, তেমনই কলকাতাও চষে বেড়াই। প্রচুর পরিশ্রম করে প্রত্যন্ত গ্রামের শিল্পীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে হয় এক-একটি শাড়ি বা গয়না। বড় দোকানের কাজের সঙ্গে আমাদের ধারার কোনও মিল নেই।’’ সঙ্গে থাকে কাজটার প্রতি একটা তুমুল ভালোবাসা। হয়তো এই সব কিছু মিলেই মানুষের কাছে ক্রমশ গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে বুটিকের পোশাক।
যদিও প্রথাগত ব্যবসায়ীরা অবশ্য বুটিক নিয়ে খুব বেশি ভাবতে রাজি নন। নবদ্বীপের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী রাজেশ অগ্রবাল যেমন বলেন, “বুটিক তখনই সফল হবে, যখন সেখানে এমন কিছু হবে, যা একেবারে আলাদা। এখানে তেমন কাজ হয় কোথায়! সেই রকম কাজ করতে গেলে যে দাম পড়বে, এখানকার ক্রেতারা তা মোটেই দিতে চাইবেন না।”
নবদ্বীপের এক পাইকারি শাড়ি বিক্রেতা দীপু মোদক আবার মনে করেন বুটিকের শাড়ি এখনও একটা বিশেষ শ্রেণির মহিলারাই ব্যবহার করেন। মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারর মহিলারাই এই ধরনের শাড়ির ক্রেতা। কিন্তু সাধারণ ঘরের মহিলারা এখনও শাড়ি বলতে বোঝেন তাঁত কিংবা সিল্ক। দীপু মোদকের কথায়, ‘‘যাঁরা সারা বছর শাড়ি কেনেন, তাঁদের কথা আলাদা। কিন্তু যাঁদের বছরে ওই এক বার শাড়ি কেনা হয়, তাঁরা মোটেই বুটিকে যাবেন না।’’
যুক্তি আছে আরও। বড় দোকানের ব্যবসায়ীরা মনে করেন, বুটিকের শাড়ির দাম সব সময় বেশি হয়। কারণ, বুটিকে তো শাড়ি তৈরি হয় না। ওঁরাও শাড়ি কিনেই তাঁর উপর নানা কাজ করেন। সে ক্ষেত্রে ওই একই শাড়ির দাম বুটিক ঘুরে ক্রেতার কাছে যখন পৌঁছয়, তখন তার দাম দেড় থেকে দু’গুন হয়ে যায়। সাধারণ ক্রেতা কিন্তু এই সব কিছুই মাথায় রাখেন।
যদিও বুটিক-মালিকেরা এমন অভিযোগ মানতে নারাজ। তাঁদের কথায়, ‘‘তিনশো থেকে তেরো হাজার, সব রকমের শাড়িই বুটিকে মেলে। তাই তো এত মানুষ আসছেন।’’