প্রতীকী ছবি।
সাল ১৯১৩। উপেন্দ্রকিশোর শুরু করলেন ‘সন্দেশ’ পত্রিকা। শুধু ছোটদের জন্য, ছোটদের কথা ভেবে। রং-বেরঙের ছবি দিয়ে ছোটদের মন জয় করার এক অব্যর্থ অস্ত্র হয়ে উঠল ‘সন্দেশ’। তা যেমন সন্দেশের মতো মিষ্টি, তেমনই আবার দেশ-বিদেশের সন্দেশ বা খবরে পরিপূর্ণ। নামকরণও হয়েছিল সে কথা ভেবেই। শুধু ছোটরাই নয়, ছোটদের সঙ্গে সঙ্গে সন্দেশ গিলে খেতে লাগলেন বড়রাও।
তখন সময়টা ছিল খানিক আলাদা। এখনকার তুলনায় সাদা-কালো তো বলাই চলে। তবু কিছুটা রং আনার চেষ্টা করেছিলেন অনেক লেখক-কবি। সন্দেশের মতো অনেক পত্রিকা আর বইয়ের পাতায় বুঁদ হয়ে গিয়েছিল ছোটরা। তবে, তখনকার ছোটদের ঘুম পাড়ানোর জন্য ঘুমপাড়ানি গানটাই লাগত। আর লাগত রূপকথা, গল্পকথা। যে রূপকথার জগতে ভাসতে ভাসতে তারা হয়ে যেত কখনও রাজা, কখনও-বা রানি। যে রাজা-রানির দুঃখ-সুখের স্রোতে অবগাহন করে তন্ময় হয়ে উঠত শিশুমন। ঠিক যেন পথের পাঁচালির অপু। জানলার বাইরে বাঁশবন বা দুপুরের রোদ মাখানো ঘেঁটু বনের দিকে তাকিয়ে যে তন্ময় হয়ে উঠত। রাঙা রোদ মাখানো গাছের দিকে চেয়ে মহাভারতের কর্ণের জন্য যার মন কেমন করে উঠত। সে দেখতে পেত, অনেক দূরে কোথাও যেন সেই বীর মাটি থেকে রথের চাকা প্রাণপণে টেনে তোলার চেষ্টা করছে— ‘মায়ের মুখে এই অংশ শুনিতে শুনিতে দুঃখে অপুর শিশুহৃদয় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিত, চোখের জল বাগ মানিত না।’
‘সন্দেশ’ প্রকাশের পর পেরিয়ে গিয়েছে একশো বছরেরও বেশি সময়। এরই মধ্যে অপুরা হঠাৎ করেই কোথায় যেন বদলে গেল! নরম তুলতুলে গাল দিয়ে গড়িয়ে পড়া জলও যেন শুকিয়ে গেল কোন এক কৃত্রিম দুনিয়ার মন্ত্রবলে। গাছের ডাল দিয়ে অস্ত্র না বানিয়ে তাদের হাত দু’টো হঠাৎ কেমন যেন ব্যস্ত হয়ে গেল কি-বোর্ডে, চোখ আটকালো স্ক্রিনে। তা সে মোবাইল হোক বা টিভি, কবে যেন বন্ধ হয়ে গেল ‘নালক’ বা ‘বুড়ো আংলা’র মতো বইয়ের পাতা। উড়কি ধানের মুড়কির ঠাট্টাকে সরিয়ে রেখে আমরা তখন হাসছি টম অ্যান্ড জেরির দুষ্টুমি বা সিনচ্যানের চঞ্চলতায়। আমাদের মন, মনন সবটাই বইয়ের পাতা পেরিয়ে পৌঁছে গেল ওই চার চৌকো বাক্সটায়। ‘হাঁসজারু’ বা ‘বকচ্ছপ’ শুনে আমরা যত না বেশি অবাক হয়েছি, তার চেয়ে তাজ্জব বনে গেলাম মোটু পাতলুর আজগুবি কারবার দেখে। কুমড়ো পটাশ বা বোম্বাগড়ের রাজাকে সরিয়ে বাসা বাঁধল ‘নডি’র পুতুলসাম্রাজ্য। দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে আমাদের ছেলেমেয়েরা ভাতের থালা নিয়ে গোগ্রাসে গিলতে শুরু করল ‘অসওয়াল্ড’ নামের অক্টোপাস আর তার পেঙ্গুইন বন্ধুকে। ‘মেঘ মুলুকের ঝাপসা রাতে, রামধনুকের আবছায়াতে’ বসে কেউ চড়ল না ‘স্বপ্নঘোড়া’য়।
আক্ষরিক অর্থে যারা শিশু, নেহাত বাচ্চা, তাদের জন্য বই লিখে গিয়েছেন অনেকেই। যেমন, যোগীন্দ্রনাথ সরকার। তাঁর টান ছিল ছোটদের দিকেই। কিংবা সুখলতা রাও। মন কেমন করা দুপুরে মাদুর পেতে বসে মা-ঠাকুমার মুখে গল্প শোনার সে এক দিন ছিল। তারপর বদলে গেল সব কিছুই। বাচ্চাদের হাতে এল ইউটিউব। চলতে থাকল ছোটা ভীম। কেশনগরের মশাকে ওরা চিনল না বটে, কিন্তু চিনে গেল ‘জগ্গু’কে।
বদলাল খেলার জগতও। দু’হাতের মুঠোয় চলে এল রহস্য রোমাঞ্চে ভরা আশ্চর্য সব দুনিয়া। যা নিয়মহারা নয় বটে, কিন্তু আজব সব নিয়মে বাঁধা। গল্প হারিয়ে গেল। হারালো ঠাকুমার ঝুলি। সেই সময়টা দখল করল সাবওয়ে সারফার, যেখানে মুদ্রা সংগ্রহে উঠেপড়ে লাগল শিশুরা। না বুঝে চিনে গেল অর্থের জগতে। গোয়েন্দা গল্প ভুলে সমাধান করতে লাগল ‘মার্ডার-ইন-নিউইয়র্ক’-এর রহস্য। ‘চারু ও হারু’ কে যারা চিনত না, তাদের কাছে এক ডাকেই পরিচিত হয়ে গেল ডোরেমন-নবিতা।
এ বার পালা বড়দের। শুধু কী ছোটরা! ‘চৌরাস্তার মোড়ে, পার্কে, দোকানে’ সর্বত্রই যেন তুমুল ব্যস্ততা। আর খেলার মধ্যেও তো রয়েছে সেই রাস্তাই। কখনও স্ট্রিট ফাইটারস্, রোড র্যাশ, কিং অব ফাইটারস্। আবার আছে আলাদিন। আশ্চর্য প্রদীপের খোঁজ সে রাখে কি না, জানা নেই অবশ্য। আর একদিন যাবৎ একটাই নাম সর্বত্র— ‘পাবজি’ কহে তারে।
কোনও পুরস্কার নেই। তবু যেন এক প্রতিযোগিতার শিকার আমরা সকলেই। প্রয়োজনে গৃহত্যাগী হতেও রাজি। এক কৃত্রিম মাঠে ছুটছি আমরা। কোনওদিন গন্তব্যে পৌঁছব না জেনেই। মাঠে না গিয়ে পায়ের উপর পা তুলে ফুটবল খেলার সুখ কত সহজেই না বুঝে গেলাম আমরা! বন্ধু চিনলাম না! ‘ননএনিমি’দেরই ভেবে বসলাম পরমাআত্মীয়! পরিণাম জানলাম না, বুঝলাম না। ঢুকে গেলাম চারচৌকো এক বাক্সে।
শেষের কথা অবশ্য আর কেই-বা ভাবে! ‘শেষে নেওয়া যাবে শেষকার পথ চিনে।’