ডাক্তারদের বাধার মুখে নিখরচার সরকারি স্টেন্ট প্রকল্প

সরকারি হাসপাতালে ফুলেফেঁপে ওঠা স্টেন্ট-চক্র ভাঙার চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হয়েছে রাজ্য সরকার। এ বার গরিব মানুষের জন্য নিখরচায় স্টেন্ট দিতে গিয়েও ফের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হল স্বাস্থ্য দফতরকে। এক মাস আগে রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলিতে চালু হয়েছে বিপিএল স্টেন্ট পরিষেবা। এই প্রকল্পে দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী হৃদ্রোগীরা বিনামূল্যে স্টেন্ট বসাতে পারবেন। কিন্তু অধিকাংশ হাসপাতালেই দুঃস্থ রোগীরা সেই সুযোগ পাচ্ছেন না।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৫ ০৩:৩৬
Share:

সরকারি হাসপাতালে ফুলেফেঁপে ওঠা স্টেন্ট-চক্র ভাঙার চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হয়েছে রাজ্য সরকার। এ বার গরিব মানুষের জন্য নিখরচায় স্টেন্ট দিতে গিয়েও ফের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হল স্বাস্থ্য দফতরকে।

Advertisement

এক মাস আগে রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলিতে চালু হয়েছে বিপিএল স্টেন্ট পরিষেবা। এই প্রকল্পে দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী হৃদ্রোগীরা বিনামূল্যে স্টেন্ট বসাতে পারবেন। কিন্তু অধিকাংশ হাসপাতালেই দুঃস্থ রোগীরা সেই সুযোগ পাচ্ছেন না। বেশ কিছু জায়গায় চিকিৎসকেরাই ওই স্টেন্ট বসানোর ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কলকাতা ও জেলার একাধিক হাসপাতালের রোগীদের অভিযোগ, ডাক্তারবাবুরা তাঁদের বলেছেন, ‘ওই স্টেন্টের মান এতই খারাপ যে, বসানো বা না বসানো একই ব্যাপার।’ বহু ক্ষেত্রে এই কথায় বিভ্রান্ত হয়ে কার্যত ঘটি-বাটি বিক্রি করে স্টেন্টের দাম জোগাড় করছেন গরিব মানুষেরা।

সরকারি পরিষেবার সুফল যে সঠিক জায়গায় পৌঁছচ্ছে না, সেই তথ্য জানেন স্বাস্থ্যকর্তারাও। কী ভাবে এই প্রতিরোধের পাল্টা জবাব দেওয়া যায়, সে ব্যাপারে প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁরাও। স্বাস্থ্য সচিব মলয় দে-র বক্তব্য, “যে কোনও ভাল কাজ করতে গেলেই প্রতিরোধ আসে। ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকানের ক্ষেত্রেও দেখেছি, এটা হয়েছে। এটা আমরা সামলে নিতে পারব। কারণ, লক্ষ্যটা আমাদের কাছে খুব স্পষ্ট।” মলয়বাবু বলেন, “কোনও ডাক্তার যদি বলেন যে এই সব স্টেন্টের মান খারাপ, এতে কাজ হয় না, তা হলে তাঁকে সেটা লিখে দিতে হবে। যদি তাঁরা দিনের পর দিন মৌখিক ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন, তা আমরা বরদাস্ত করব না। অন্য দিকে, যদি মান খারাপের প্রশ্ন ওঠে তা হলে সেটাও যাচাই করে দেখা হবে। স্টেন্টের মান যথাযথ না হলে সংশ্লিষ্ট সরবরাহকারী সংস্থার লাইসেন্স বাতিল হতে পারে।”

Advertisement

বছর দশেক আগে বাম আমলেই দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী হৃদ্রোগীদের নিখরচায় স্টেন্ট দেওয়ার ভাবনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু কিছুটা আর্থিক কারণ আর অনেকটাই চিকিৎসকদের একটা বড় অংশের প্রতিরোধে তা সম্ভব হয়নি। পাশাপাশি সরকারি হাসপাতালে ফুলেফেঁপে ওঠা স্টেন্ট-চক্রকে যে ভাঙা যাচ্ছে না, সেটাও মেনে নিয়েছিলেন স্বাস্থ্যকর্তারা। তাই বিপিএল পেসমেকার চালু হলেও বিপিএল স্টেন্ট চালু করা যায়নি। স্টেন্টের দাম জোগাড় করতে নাভিশ্বাস উঠেছে বহু মানুষের। এত দিনে বিপিএল স্টেন্ট চালু করা সম্ভব হলেও কী ভাবে তা বাস্তবে কার্যকরী করা যায়, সেটাই এখন স্বাস্থ্যকর্তাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ।

এখনও পর্যন্ত বিপিএল স্টেন্ট বসানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে সফল বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ। আর সবচেয়ে খারাপ অবস্থা কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের। দোলের দিন বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একই দিনে আটটি বিপিএল স্টেন্ট বসেছে। স্বাস্থ্যকর্তারা তা নিয়ে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত। তাঁদের কাছে এটা ব্যতিক্রমী। অন্য দিকে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতাল, যেখানে মাসে ২০০-টির উপরে স্টেন্ট বসে, সেখানে এক মাসে বিপিএল স্টেন্ট বসেছে মাত্র পাঁচটি।

বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক বিশ্বকেশ মজুমদার বলেন, “মাসিক আয় দু’হাজার টাকার কম হলে বিপিএল স্টেন্ট দেওয়া হবে। স্টেট ইলনেস ফান্ড-এর আওতায় এই খরচ বহন করা হচ্ছে। এই প্রকল্প কার্যকরী হলে কত গরিব হৃদ্রোগী যে সুফল পাবেন, তার ইয়ত্তা নেই।”

তা হলে অধিকাংশ হাসপাতাল পিছিয়ে আসছে কেন? এসএসকেএমের কার্ডিওলজি বিভাগের এক চিকিৎসকের কথায়, “সরকার ৩০ হাজার টাকায় যে স্টেন্ট দিচ্ছে, তার মান অত্যন্ত খারাপ। তাই আমরা ওটা লাগাতে উৎসাহ দিই না।” আর জি করের এক চিকিৎসক সোজাসাপ্টা বলছেন, “ওই স্টেন্ট বসালে হিতে বিপরীত হতে পারে। তখন তার দায় তো আমাদের উপরেই আসবে।” তাঁরা কি সরকারকে লিখিত ভাবে সে কথা জানিয়েছেন? ওই চিকিৎসকদের জবাব, “লিখিত ভাবে এ সব জানিয়ে চাকরি খোয়াব নাকি?” কিন্তু গরিব মানুষ, যাঁরা স্টেন্টের টাকা জোগাড় করতে পারছেন না, তাঁদের কাছে বিকল্প ব্যবস্থা তা হলে কী হতে পারে? এই প্রশ্নের কোনও জবাব তাঁদের কাছে মেলেনি।

স্বাস্থ্যকর্তারা অবশ্য দাবি করেছেন, ২০ হাজার টাকায় বিপিএল পেসমেকার চালু করার সময়েও মান নিয়ে এমন নানা প্রশ্ন, সংশয় তোলা হয়েছিল। ওই পেসমেকারের মান যে খারাপ নয়, তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। স্টেন্টের ক্ষেত্রেও সেটাই হবে বলে আশাবাদী তাঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন