হাম-বসন্তে অবহেলা নয়

শীত বিদায় নিয়েছে। বাড়তে শুরু করেছে তাপমাত্রা। এই ঋতু পরিবর্তনের সময়ে হাম ও বসন্তের কারণে বাড়ে সমস্যা। কী ভাবে সুস্থ থাকবেন, জানাচ্ছেন চিকিৎসক দীপককুমার সাহাশীত বিদায় নিয়েছে। বাড়তে শুরু করেছে তাপমাত্রা। এই ঋতু পরিবর্তনের সময়ে হাম ও বসন্তের কারণে বাড়ে সমস্যা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

জটিলতা কমাতে সময়মতো চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। নিজস্ব চিত্র

প্রশ্ন: এখন ঋতু পরিবর্তনের সময়। রোগব্যাধি বাড়ে। এ সময়ে কী কী রোগ থেকে সাবধানে থাকতে হবে?

Advertisement

শীত শেষে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন জীবাণুরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। সাধারণ জ্বর, সর্দিকাশি ছাড়াও এ সময়ে হাম ও বসন্তের প্রকোপ দেখা যায়।

Advertisement

প্রশ্ন: এই সময়েই বিশেষ করে কেন হাম ও বসন্তের প্রাদুর্ভাব হয়?

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঋতু পরিবর্তনের সময়ে হাম ও বসন্তের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। তবে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে এখন এই সব রোগ হওয়ারও কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই। যখন তখন এর প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। যেহেতু এই জাতীয় রোগগুলি ভাইরাস সংক্রমণ দ্বারা হয়ে থাকে, তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগগুলির ভাইরাস অনুকূল পরিবেশ পেয়ে আক্রমণ করে।

এখন মানবদেহের প্রতিরোধ ক্ষমতার উপরে নির্ভর করে, ভাইরাসের আক্রমণে শরীর কতখানি প্রভাবিত হবে।

প্রশ্ন: হাম বা বসন্তের কি কোনও সাধারণ উপসর্গ আছে?

যেহেতু ভাইরাস ‘কালচার’ করা এখনও সম্ভব হয়ে উঠেনি, তাই এই সব ভাইরাল রোগগুলি মূলত রোগের উপসর্গ বা লক্ষণ দেখেই শনাক্ত করতে হয়। প্রাথমিক ভাবে জ্বর, সর্দি, হাঁচি, সারা শরীরে ব্যথা ইত্যাদি দেখা যায়। পরবর্তী পর্যায়ে গায়ে বিভিন্ন আকারের দানা ও আরও পরে জলভর্তি ফোস্কার মতো বড় আকারের দানা বা পুঁজ সমেত বড় আকারের দানাও দেখা যায়।

প্রশ্ন: হামের লক্ষণগুলি কী কী?

প্রাথমিক লক্ষণ জ্বর। সঙ্গে সর্দি, হাঁচি, চোখ লাল হওয়া, কিছু ক্ষেত্রে চোখের পাতা ফুলে যাওয়া, চোখ দিয়ে জল পড়া, কাশি, গলার স্বর বসে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গগুলি দু-তিন দিন থাকে। মুখের ভিতরে দানা দানা ভাব দেখা দেয় এবং আস্তে আস্তে তা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এর ৩-৪ দিনের পরে ওই দানাগুলি আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায় এবং শরীর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠে।

প্রশ্ন: হামের সঙ্গে রুবেলার পার্থক্য কোথায়?

রুবেলার ক্ষেত্রে জ্বর, সর্দি, হাঁচির পরিমাণ অতটা প্রকট নয়, যেটা হামের ক্ষেত্রে হয়। তবে রুবেলার ক্ষেত্রে প্রথমে শরীরে গোলাপি রঙের দাগ দেখা যায়। কানের পিছনের দিকে, বুকের সামনে ও পিছনে এবং পরে হাতে-পায়েও সেই দাগ দেখা দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে হামের মতো চোখের মধ্যে কোনও লক্ষণ দেখা যায় না। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে গলার পিছনের দিকে গ্রন্থি ফোলা লক্ষ করা যায়। আবার, ঘাড়ে শক্ত ভাব থাকলে মেনিনজাইটিসের সঙ্গে তুলনা করে চিকিৎসা শুরু করা হয়। কখনও অনেকগুলি গ্রন্থি বিভিন্ন জায়গায় ফুলে উঠতে পারে।

প্রশ্ন: জল বসন্তের লক্ষণগুলি কী কী?

জ্বর, মাথা ব্যথা, গলা ব্যথা ছাড়াও মূল লক্ষণ হিসেবে মুখের ভিতরে উপরের চোয়ালে, বুক, পিঠ, মুখ এবং পরবর্তী কালে হাত-পা ও মাথায় বিভিন্ন আকারের দানা দেখা যায়। এক দু’দিন পরে সেগুলি আকারে বড় হতে থাকে। পরে সেগুলির মধ্যে তরল জমা হয়ে ফোস্কার আকার নেয়। আরও পরে পুঁজ হয়। হাত-পায়ে যেহেতু চুলকানির প্রবণতা থাকে, তাই সামান্য নখের আঁচড়েই সেগুলি ফেটে গিয়ে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে।

প্রশ্ন: গুটি বসন্ত কী?

অনেক দিন আগেই টিকাকরণের ফলে গুটি বসন্ত বা ‘স্মল পক্স’ সম্পূর্ণ রূপে আমদের দেশ থেকে নির্মূল হয়েছে। এখন যে বসন্ত দেখা যায়, তা জল বসন্ত বা ‘চিকেন পক্স’।

প্রশ্ন: এই সব রোগ থেকে আগে থেকে সাবধান হওয়ার উপায় আছে কি?

সময়মতো টিকাকরণে অনেক ভাইরাসজনিত রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। আর সাবধানতা হিসেবে রোগের লক্ষণ ধরা পড়ার পরে বাড়ির অন্য সকলকে একটু সতর্ক থাকা দরকার। যেমন, রোগ ধরা পড়লে প্রথমেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সাধারণ কিছু স্বাস্থ্যবিধিও মেনে চলতে হবে।

প্রশ্ন: হাম বা বসন্ত থেকে কী কী ধরনের বিপদের আশঙ্কা থাকে?

হাম বা বসন্তের কারণে সাধারণত শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সাময়িক কমে যায়। সচেতন না হলে নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস, কাশি, পেটের গোলমাল দেখা দিতে পারে। কোনও পুরনো বা জটিল রোগ থাকলে বসন্ত হওয়ার ফলে তা আরও বাড়তে পারে। সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রাণহানির আশঙ্কাও থেকে যায়। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনুযায়ী হাম বা বসন্ত কতটা প্রভাব ফেলবে, তা নির্ধারিত হয়। তবে উপসর্গ দেখা দিলেই দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

প্রশ্ন: হাম বা বসন্তের মতো ভাইরাসঘটিত রোগের চিকিৎসা কী ভাবে সম্ভব?

আগেই বলেছি, এই ধরনের রোগ থেকে মুক্তি পেতে অবশ্যই সময়মতো টিকাকরণ করতে হবে। তা ছাড়া, আমরা যদি নিয়মিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি তা হলে ৫০ শতাংশ সংক্রামক রোগ থেকে মুক্তি পেতে পারি। পাশাপাশি, পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখাটাও জরুরি। অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে। ‘সেকেন্ডারি ইনফেকশন’ হলে কিছু ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ওযুধও দেওয়া হয়।

প্রশ্ন: শিশু ও কমবয়সিরা সাধারণত হাম বা বসন্তে বেশি আক্রাম্ত হয়। এমনটা কেন?

যেহেতু শিশু ও কমবয়সিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক ভাবে কম, তাই তারা এই ধরনের ভাইরাসঘটিত রোগের শিকার বেশি হয়।

প্রশ্ন: শিশুদের কী ভাবে যত্ন নেওয়া দরকার?

সাধারণ ভাবে শিশুদের হাম বেশি হয়। তবে বড়দের হবে না, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। সাধারণ ভাবে এক বার হাম হলে দ্বিতীয় বার হওয়ার আশঙ্কা থাকে কম। তবে সতর্ক থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। হাম হলে তিন-চার দিন জ্বর থাকে। জ্বর বেশি হলে বমিও হতে পারে। তবে চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি। আক্রান্ত শিশুদের প্রচুর জল পান করাতে হবে। দু’বছরের কম বয়স হলে মায়ের দুধ ঘন ঘন দিতে হবে। না হলে শিশু দুর্বল হয়ে পড়বে।হামে আক্রান্ত রোগীদের ভিটামিন এ-র অভাব হতে পারে। তাই সে ক্ষেত্রেও চিকিৎসকই শেষ কথা। কোনও পরিস্থিতিতেই নিজেরা চিকিৎসা করতে যাবেন না। হামে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে শিশুদের যতটা সম্ভব দূরে রাখতে হবে। হামের জীবাণু বাতাসে প্রায় এক ঘণ্টা সক্রিয় থাকে। কাজেই হামে আক্রান্ত ব্যক্তি সরে যাওয়ার পরেও সুস্থ শিশুরা নিরাপদ নয়। শিশুদের হাম খুব মারাত্মক নয়, তবে চিকিৎসা না করালে নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে।

প্রশ্ন: টিকাকরণের ক্ষেত্রে কী কী বিষয় মাথায় রাখা জরুরি?

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, হামের টিকা এক ‘ডোজ’ দেওয়ার পরেই তা বন্ধ করে দিয়েছেন অভিভাবক। সে ক্ষেত্রে হামের প্রকোপ হতেই পারে। এ ছাড়া, টিকাকরণে কোনও ত্রুটি থাকলেও হাম হতে পারে। প্রত্যেক অভিভাবককে মনে রাখতে হবে, শিশুর ন’মাস ও ১৫ মাসে হামের টিকা দেওয়া জরুরি। তবে টিকা দিলেও তা পুরোপুরি সফল না-ও হতে পারে। তবে স্বাস্থ্যসমীক্ষা অনুযায়ী বলা যেতে পারে, দু’ডোজ টিকা দিলে শিশু ৯৫- ৯৭ শতাংশ নিরাপদ। শিশুদের হামের টিকা সরকারি হাসপাতাল থেকেই নেওয়া উচিত।

প্রশ্ন: হাম বা বসন্ত হলে কী ভাবে রোগীর যত্ন নেওয়া উচিত?

হাম বা বসন্তের নির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা নেই। রোগের উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে রোগী দুর্বল হয়ে যায়। তাই পুষ্টিকর খাবার দেওয়া উচিত। নিরামিষ বা আমিষের কোনও ব্যাপার নেই। রোগী যা খেয়ে হজম করতে পারে, তা-ই দেওয়া দরকার। বিশেষ করে জলীয়, তরল খাবার খুবই প্রয়োজন। তেল, সাবান ব্যবহার না করে মৃদু গরম জলে স্নান করা যেতে পারে। সুযোগ থাকলে আলাদা ঘরে রোগীর থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ৫-৭ দিন পরে যখন গুটির খোসা উঠতে শুরু করে, তখন একটু বেশি সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। তাই ওই সময়ে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।

সাক্ষাৎকার: অভিজিৎ অধিকারী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন