জলে দূষণের ফলেই যে শহর জুড়ে ডায়েরিয়া বাড়ছে, শুক্রবার তা মানতে চাননি মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে শেষ পর্যন্ত আজ, রবিবার পানীয় জলের কলগুলি তরল ক্লোরিন দিয়ে শোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কলকাতা পুরসভা। পাশাপাশি, ডায়েরিয়া (নাইসেড-এর মতে, বহু ক্ষেত্রেই যা কলেরা) আক্রান্ত হয়ে শহরের যে সব এলাকা থেকে রোগীরা বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, সেখানকার পানীয় জলের নমুনাও পরীক্ষা করা হবে। অর্থাৎ, প্রকারান্তরে পুর-কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে নিলেন, শহর জুড়ে পেটের রোগের যে প্রাদুর্ভাব, পুরসভার সরবরাহ করা পানীয় জলে দূষণ তার উৎস হতেই পারে।
পুরসভার স্বাস্থ্য দফতরের মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষ শনিবার জানান, রবিবার শহরের ৭০টি এলাকার স্ট্যান্ড কলের জল পরীক্ষা করবে পুর-প্রশাসন। এ ছাড়া, আই ডি হাসপাতালের রেজিস্টার থেকে রোগীদের বাড়ির ঠিকানা নিয়ে এলাকায় জল শোধনের কাজও শুরু হচ্ছে। তাই আজ, রবিবার পুরসভার স্বাস্থ্য ও জল সরবরাহ দফতরের কর্মীদের ছুটি বাতিল হয়েছে বলে জানান তিনি।
ডায়েরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বেলেঘাটার আই ডি হাসপাতালে যাঁরা ভর্তি হয়েছেন, তাঁদের কেউ তিলজলা-তপসিয়া, কেউ হাতিবাগান- টালাপার্ক, কেউ বা ভবানীপুর, মুকুন্দপুর বা যাদবপুরের বাসিন্দা। পুরসভা সূত্রে খবর, এই রোগীদের মধ্যে ৮৭ জন কলকাতার বাসিন্দা। ওই হাসপাতালে রোগীর ভিড় উপচে পড়ায় শুক্রবার সেখানে যান স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। পরে শনিবার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আই ডি হাসপাতাল থেকে রেকর্ড আনিয়েছি। বেশির ভাগই বাইরের রোগী। কলকাতারও আছে, তবে কম। ওই রোগীরা মূলত তিলজলা, তপসিয়া, ভবানীপুর ও কালীঘাট এলাকার। আমি প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। আজই পুর-কমিশনের সব এগ্জিকিউটিভদের জলমগ্ন এলাকাগুলির জল পরীক্ষা করতে বলা হয়েছে।’’ তিনি স্বীকার করেন, ‘‘গঙ্গার জল উপচে পড়ায় খালের নোংরা জল শহরে ঢুকতে পারে। তাই কলের জল ক্লোরিন দিয়ে পরীক্ষা করতেও বলা হয়েছে। পাশাপাশি, গঙ্গার যে জল পরিশুদ্ধ হয়ে টালা, পলতা, গার্ডেনরিচ বা ধাপায় যায়, তা-ও পরীক্ষা করতে বলা হয়েছে।’’
মেয়র জানিয়েছিলেন, জল দূষণ নিয়ে কোনও অভিযোগ তিনি পাননি। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, অভিযোগ না পেলে কি মেয়র বা পুর-প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নেবে না?
পুরসভার স্বাস্থ্য দফতরের মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষ অবশ্য বলেন, ‘‘আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। বৃষ্টিতে কিছু এলাকা জলমগ্ন হতেই পুরসভার স্বাস্থ্যকর্মীরা সেখানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত খবর নিয়েছেন।’’ তিনি জানান, ব্লিচিং ছড়ানো হয়েছে, ওআরএস, হ্যালোজেন দেওয়া হয়েছে। কাউন্সিলরেরাও খবর রাখছেন।
ভবানীপুর, পদ্মপুকুর এলাকার কাউন্সিলর বিজেপির অসীম বসু জানান, ওই অঞ্চলে ডায়েরিয়ার খবর মিলেছে। তিনি জানান, পদ্মপুকুরে একই বাড়িতে ছ’জনের ডায়েরিয়া হয়েছে। তাঁর অভিযোগ, ‘‘দিন কয়েক আগে কল থেকে ঘোলা জল বেরিয়েছিল। সম্ভবত সেটাই বিপত্তির কারণ।’’ একই অভিযোগ উত্তর কলকাতার গৌরীবাড়ি এবং কাঁকুড়গাছির কিছু বাসিন্দারও।
পুরসভার জল সরবরাহ দফতরের এক অফিসারের কথায়, জলে দূষণ থেকেই এমন হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। আর তা হয়েছে শহর জুড়ে ভারী বৃষ্টির কারণে। তা ছাড়া, সম্প্রতি শহরের মূল জল প্রকল্প টালা-পলতার পাইপ লাইনে ফাটল দেখা দিয়েছিল। সেখান দিয়ে মাটি ঢুকে জল দূষিত হয়ে এই সমস্যা হতে পারে। তবে ওই পাইপ পাল্টানো হয়েছে। তা ছাড়া, যে সব এলাকা বৃষ্টির জেরে জলমগ্ন ছিল, সেখানকার পানীয় জলের (স্ট্যান্ড) কল নোংরা জলে ঢুবে যায়। সেই জল পাইপের মধ্যে ঢুকে পরে জল সরবরাহ চালু হতেই চলে গিয়েছে বহু বাড়িতে। এ-ও রোগের কারণ হতে পারে। কারণ ডায়েরিয়া বা কলেরা যাই হোক, সবই জলবাহিত, জানান ওই অফিসার।
এই সব আঁচ করেই পুর-প্রশাসন জল পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান দফতরের এক ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু আই ডি ছাড়া অন্য হাসপাতলে ডায়েরিয়া আক্রান্ত রোগী ভর্তি রয়েছে কি না, পুরসভা কি সে খবর নিচ্ছে? মেয়র পারিষদ অতীনবাবু জানান, স্বাস্থ্য দফতর প্রতিনিয়ত খোঁজ নেয়। আই ডি হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই কাজ করা হচ্ছে।
আন্ত্রিকের প্রকোপ হাওড়াতেও। জমা জল নেমে যাওয়ার পরেই হাওড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়েও শুরু হয়েছে আন্ত্রিকের প্রকোপ। গত কয়েকদিনে এই রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকায় তাই চিন্তিত জেলা স্বাস্থ্য দফতর। ওই দফতরের তরফে জানানো হয়েছে, হাওড়ার সত্যবালা আই ডি-সহ ওই জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে এখনও পর্যন্ত ১৫০ জন আন্ত্রিক রোগী ভর্তি হয়েছেন। তাদের অধিকাংশ শিশু। হাওড়া পুরসভা সূত্রে খবর, উত্তর হাওড়ার জলমগ্ন ওয়ার্ডগুলির মাটির নীচে পাইপ ফেটে গিয়ে খাবার জলের সঙ্গে বিষাক্ত জল মিশেই এই বিপত্তি। এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান জঞ্জাল অপসারণ দফতরের মেয়র পারিষদ গৌতম চৌধুরী। তিনি জানান, বিভিন্ন এলাকায় ওআরএস ও হ্যালোজেন ট্যাবলেট বিলি করছে পুরসভা। হাওড়ার মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকারিক ভবানী দাস জানান, রোগ মোকাবিলায় পর্যাপ্ত ওষুধ হাসপাতালগুলিতে মজুত আছে। এ ছাড়া, স্বাস্থ্যকর্মীরা এলাকায় গিয়ে বাসিন্দাদের জল ফুটিয়ে খেতে এবং খাওয়ার আগে হাত-মুখ পরিষ্কার করে নিতে অনুরোধ করছেন।