Durga Puja Bhog

পুজোর ভোগেও কর্পোরেটের ছোঁয়া, বরাত পাচ্ছে নানা রেস্তরাঁ, তাতে বদলাচ্ছে কি বাণিজ্যিক কাঠামো?

বাঙালির সাধের দুর্গোৎসব এক সময়ে রীতিমতো কর্পোরেট কেন্দ্রিক হয়ে উঠবে, আন্দাজ করা গিয়েছিল থিম পুজোর শুরুতেই। এই বদল যে কেবল দুর্গামূর্তি গড়াতেই এসেছে, তা নয়। কর্পোরেটের ছোঁয়া লেগেছে পুজোর ভোগেও।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২৫ ১০:৩৩
Share:

দুর্গাপুজোর ভোগের বরাত পাচ্ছে বিভিন্ন রেস্তরাঁ, তাতে ব্যবসায় কি বদল আসছে? গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

দুর্গাপুজোর ভোগও এখন বাণিজ্যের অঙ্গ।

Advertisement

এমনিতে পুজোর ভোগ মানে যে সে ব্যাপার নয়! যেমন তার আয়োজন, তেমনই তার রান্না আর তার সঙ্গে মানানসই তার পরিবেশন। রাজা-জমিদারদের বাড়ির উঠোনে, ঠাকুরদালানে শুরু হওয়া দেবী দুর্গার আরাধনা কালের নিয়মে সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। তার আয়োজন বিশাল, জাঁকজমকও বিপুল। ফলে পুজো ঘিরে বাণিজ্যও অনন্ত। থিম পুজোর যুগে মণ্ডপসজ্জা থেকে প্রতিমা, ঢাকের বাদ্যি থেকে পুজোর থিমের গান— ব্যবসায়ীক আদানপ্রদানের সুযোগ কম নেই। ফলে অল্প অল্প করে কলকাতার পুজো বহু বছর ধরেই হয়ে উঠেছে বাণিজ্যভিত্তিক। এখন সে বাণিজ্যে যোগ দিয়েছে পুজোর ভোগও।

এখন বহু জায়গাতেই আর মণ্ডপের পিছনে অস্থায়ী রসুইঘরে ভোগ রান্নার ফুরসত নেই কর্মকর্তাদের। তাই পুজোর ভোগেরও প্যাকেজিং হচ্ছে। বিদেশে এ ধারা শুরু হয়েছে আগেই। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে কোপেনহেগেন— সর্বত্র পুজোর ভোগের অর্ডার যায় কোনও না কোনও ভারতীয় রেস্তরাঁর কর্তার কাছে। এ দেশে সে চল হতে দেরি হলেও এখন কখনও কোনও পুজোর ভোগের বরাত পাচ্ছে আইটিসি হোটেল, তো কোথাও ভোগ বানাচ্ছে পাড়ার রেস্তরাঁ।

Advertisement

অষ্টমীর লুচিভোগ অথবা খিচুড়ি-লাবড়া বা অন্নভোগের স্বাদ থেকে যাঁরা বঞ্চিত, তাঁদের ঘরেও পৌঁছে যাচ্ছে ভোগ। গোটা বিষয়টারই বাণিজ্যিকরণ হয়েছে ইদানীং সময়ে। ‘ভোগ প্যাকেজিং’ ব্যবসার যেমন নতুন দিগন্ত খুলে গিয়েছে, তেমনই কর্মসংস্থানের সুযোগও এনে দিয়েছে।

ছবি: শাটারস্টক।

একটা সময়ে রাজবাড়ি বা জমিদারবাড়ির পুজো উপলক্ষে আট-দশটি গাঁয়ের মানুষের দু’বেলা পাত পড়ত। সেই বিপুল আয়োজন সামলানোর জন্য তৈরি হত অস্থায়ী রান্নাঘর, বসত ভিয়েন। অবস্থাপন্ন বা সম্ভ্রান্ত বনেদি বাড়ির পুজোর চিত্রটাও অনেকটা একই রকম। জমিদারবাড়ি বা রাজবাড়ির পঙ্‌ক্তিভোজে আশপাশের গ্রাম থেকে মানুষজন আসতেন পুজো দেখতে। কাজকর্মেও তাঁরা জুটে যেতেন। কেউ মায়ের অধিষ্ঠানের জায়গা গোছাতেন, কেউ হেঁশেলে লেগে যেতেন জোগাড়ে। পুজোশেষে ঠাকুরদালানের কোল ঘেঁষে পাত পড়ত বহু মানুষের। খিচুড়ির বালতি নিয়ে নেমে পড়তেন ছেলেপুলেরা। কিন্তু এখন আয়োজন আরও বড়। দুর্গাপুজো পারিবারিক থেকে সর্বজনীন হয়ে ওঠার সময় থেকেই তাতে কর্পোরেটের হাওয়া লেগেছে। কর্মব্যস্ত উদ্যোক্তারা মণ্ডপসজ্জা থেকে প্রতিমার সাজ, সবই যেমন কোনও না কোনও সংস্থার হাতে সঁপে নিশ্চিন্ত থাকছেন, তেমন কেউ কেউ ভোগের বিপুল আয়োজনের দায়িত্ব দিচ্ছেন কোনও রেস্তরাঁয়।

এই পরিবর্তন এক সময়ে ছোট ছোট পরিসরে ঘটে চলেছিল নানা জায়গায়, এখন তা-ই বৃহত্তর পরিসরে ঘটছে। আর এ পরিবর্তন স্বাভাবিক বলেই মনে করছেন শহরের নামী বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্ণধার উজ্জ্বল সিংহ। তাঁর মতে, “ব্যবসা বাড়ছে, বহু মানুষ কাজ পাচ্ছেন, ভোগ রান্নায় পরিচ্ছন্নতার বিধিও মানা হচ্ছে, তাতে মন্দ কী! ভাইফোঁটা বা জামাইষষ্ঠীতেও এখন রেস্তরাঁ থেকে খাবার আনানো হয়। নিজে হাতে রাঁধেন ক’জনে। বাঙালির বাড়িতেও এই পরিবর্তন ঘটেছে বহু সময় ধরে। ছোট পরিসরে বলে তা নজরে আসেনি। দুর্গাপুজোর মতো উৎসবও এখন বিনোদন ও বাণিজ্যকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। তা হলে সেখানে এই বদল আসাটা আশ্চর্যের কিছু নয়। বরং তাতে বৃহত্তর পরিসরে বহু মানুষের কাছে পুজোর ভোগ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ডেলিভারি বয়রা কাজ পাচ্ছেন। পুজোর প্যান্ডেলে চার জন রাঁধুনি ডেকে ভোগ রান্না করলেও তো আচারবিধি মানা হয় না, তার চেয়ে রেস্তরাঁগুলি অনেক শুদ্ধ ভাবে ও পরিচ্ছন্নতার বিধি মেনে যদি সব কিছু প্রস্তুত করে দেন, তা হলে ক্ষতি কোথায়! এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনই তো দরকার।’’

ছবি: শাটারস্টক।

ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়ার কিছু ই-কমার্স সংস্থা পুজোর ভোগের বিশেষ প্যাকেজও রাখছে। অনলাইনে অর্ডার করলে সন্তোষপুর লেকপল্লা, বকুলবাগান সর্বজনীন, আহিরীটোলা সর্বজনীনের মতো বিভিন্ন পুজোর ভোগ পৌঁছে দিয়েছে বাড়িতে। আগে রেস্তরাঁগুলির ব্যস্ততা সীমাবদ্ধ ছিল মূলত দুপুর ও রাতের খাওয়ার মধ্যে। পুজো স্পেশ্যাল মেনু বানিয়ে গ্রাহকদের মন কাড়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে অনেক আগেই। তবে ‘ভোগ কেটারিং’ শুরু হওয়ার পর থেকে, আর্থিক লেনদেনের চিত্রটা সত্যিই নজরকাড়া।

উজ্জ্বলবাবুর বক্তব্য, ব্যবসা যেমন বাড়ছে এতে, তেমনই উপকৃত হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন। ভাল প্যাকেজিং মানে বিপুল সংখ্যক অর্ডার নেওয়া সম্ভব হবে যা রান্না করে পরিবেশন করার চেয়েও বেশি লাভজনক, এমনটাই মনে করছেন রেস্তঁরা ব্যবসায়ী অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে বাণিজ্যিক বৃদ্ধি হচ্ছে অনেকটাই। বড় শহরগুলিতে এখন ‘ভোগ প্যাকেজিং’ এবং ‘ভোগ কেটারিং’ খুব জনপ্রিয়। এতে রেস্তরাঁগুলি যেমন লাভের মুখ দেখছে, তেমনই বৃহত্তর ক্ষেত্রে গ্রাহকদের পরিষেবা দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে। শুধুমাত্র একটা উৎসব উপলক্ষে ব্যবসায়িক বৃদ্ধি হচ্ছে প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। এতে যে শুধু রেস্তরাঁর আয় হচ্ছে তা নয়, প্রচারের দায়িত্ব নিচ্ছে যে সংস্থাগুলি, তারা লাভবান হচ্ছে, বিভিন্ন ই-কমার্স সংস্থা ভোগ পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পেয়ে লাভের মুখ দেখছে। গ্রাহকদের চাহিদা যত বাড়ছে, ততই নতুন অংশীদারিত্ব এবং সুযোগও তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ, দেখতে গেলে খুবই বড় পরিসরে বহু মানুষের আয়ের উৎস হয়ে উঠছে।”

তা হলে কি বলা যায় যে, পুজো ছাপিয়ে ব্যবসাই কোথাও প্রধান হয়ে উঠছে? সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায়ের ভাবনা ভিন্ন। তিনি মনে করেন, বারোয়ারি বা সর্বজনীন পুজোগুলি কোনও কালেই আচারবিধি মানার ধার ধারে না। সেখানে শিল্পের সঙ্গে সাবেকিয়ানার সংঘাতের জায়গাই নেই। মণ্ডপসজ্জা থেকে আলো, প্রতিমা সব কিছুই গড়া হচ্ছে নতুন আঙ্গিকে। প্রতিটি কাজের দায়িত্ব পাচ্ছে কোনও না কোনও বাণিজ্যিক সংগঠন। ভোগ সেখানে আর আলাদা হল কোথায়। প্রশান্তবাবুর ব্যাখ্যা, “পুজোর কর্মকর্তা তো আর নিজে লুচি বেলে পরিবেশন করবেন না, কাজেই তিনি কোনও রেস্তরাঁকে দায়িত্ব দিতেই পারেন। শিল্প ও বাণিজ্যভাবনা যদি প্রাধান্য পায়, তা হলে আলাদা করে বলার কিছু নেই। ”

দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক লেনদেনের হিসাব যে নজরকাড়া থাকে, তা গত কয়েক বছর ধরেই উঠে আসছে বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের তথ্যে। পুজোর ভোগের ক্ষেত্রে যে বদলটা আসছে বা যে নতুন ধারার চল হচ্ছে, তাকে স্বাগত জানাচ্ছে অনেক বণিক সংগঠনই। শুধু ভোগ খাওয়ানোই ‘মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি’ নয়, বরং পরবর্তী সময়ে গিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণের উপায়ও হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement