কী ভাবে নেবেন শিশুর যত্ন

শিশুর যত্ন শুরু হয়ে যায় মায়ের গর্ভাবস্থা থেকেই। জন্মের পরে শিশুর পাশাপাশি সমান যত্ন প্রয়োজন মায়েরও। জানাচ্ছেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ গোপালচন্দ্র লায়েকশিশুর যত্ন শুরু হয়ে যায় মায়ের গর্ভাবস্থা থেকেই। জন্মের পরে শিশুর পাশাপাশি সমান যত্ন প্রয়োজন মায়েরও। জানাচ্ছেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ গোপালচন্দ্র লায়েক

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:১৯
Share:

সময়মতো টিকাকরণ জীবনভর রক্ষাকবচের কাজ করে, মত চিকিৎসকের। ছবি: রথীন্দ্রনাথ মাহাতো

প্রশ্ন: কী ভাবে শিশুর যত্ন নেওয়া উচিত?

Advertisement

অনেকেই মনে করেন, শিশুর জন্মের পরেই তার স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া দরকার। তবে সেটা ঠিক নয়। জন্মের আগে থেকেই শিশুর যত্ন নেওয়া শুরু করা উচিত।

প্রশ্ন: জন্মের আগে কী ভাবে শিশুর যত্ন নেওয়া সম্ভব?

Advertisement

অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালীনই গর্ভস্থ সন্তানের যত্ন শুরু করা দরকার। গর্ভাবস্থায় ১২ সপ্তাহের মাথায় ধনুষ্টঙ্কারের টিকা নিতে হবে। হবু মায়ের নিয়মিত ওজন নিতে হবে, যাতে মা ও গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্য ঠিক আছে কি না বোঝা যায়।
১৪ সপ্তাহের পরে আরও একটি টিকা নেওয়া দরকার। যে সব পরিবারে জন্ডিস এবং বংশগত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস রয়েছে অর্থাৎ যে সব অসুখ গর্ভবতীকে প্রভাবিত করতে পারে, সেগুলি থেকে হবু মা ও শিশুকে দূরে রাখার যাবতীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। হেপাটাইটিস বি, আর এইচ নেগেটিভ থাকলে পরীক্ষা করিয়ে সেগুলির প্রতিষেধক নিতে হবে। শিশুর স্বাস্থ্যের হালহকিকত সম্বন্ধে জানতে যে সব পরীক্ষা সহায়ক, মায়ের রক্তপরীক্ষার মাধ্যমে সেগুলিও করিয়ে নিতে হবে।

শুধু তাই নয়, গর্ভাবস্থায় মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যও যাতে ঠিকঠাক থাকে, সে দিকেও সমান ভাবে নজর দেওয়া জরুরি। যে কোনও ধরনের মানসিক অশান্তি, দুশ্চিন্তা বা টেনশন শিশুর পক্ষে ক্ষতিকারক।

প্রশ্ন: শিশুর জন্মের পরে পরেই কী ধরনের সাবধানতা নেওয়া উচিত?

জন্মের পরেই শিশুকে যক্ষ্মার টিকাকরণ করাতে হবে। গর্ভাবস্থায় ধনুষ্টঙ্কারের টিকা নেওয়া থাকলে এর পরেই হাম, হুপিং কাশির মতো রোগের প্রতিষেধক নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, পোলিও, ডিপথেরিয়া, পার টু সিস (হুপিং কাশি), টিটেনাস, হেপাটাইটিস বি এবং হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা (টাইপ-বি), এই সমস্ত রোগের টিকাকরণ অত্যন্ত জরুরি। শিশু বয়সে এই ধরনের টিকাকরণগুলি জীবনভর রক্ষাকবচের কাজ করবে।

প্রশ্ন: অনেকেই বলেন, মাতৃদুগ্ধ শিশুর কাছে অমৃতের সমান। মাতৃদুগ্ধের উপযোগিতা ঠিক কতখানি?

এককথায় বললে শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ও প্রতিষেধক হিসেবে মাতৃদুগ্ধের কোনও বিকল্প নেই। মায়ের দুধ যেমন শিশুর খিদে মেটায়, পুষ্টি জোগায় তেমনই
অনেক রোগের প্রতিষেধক হিসেবেও কাজ করে। প্রসবের পরে মায়ের প্রথম গাঢ় হলুদ দুধ, যাকে ‘কোলোস্ট্রাম’ বলা হয়, শিশুর জন্য অত্যন্ত জরুরি। এই দুধ যাতে প্রত্যেক সদ্যোজাত পায়, সে দিকে লক্ষ দিতে হবে।

প্রশ্ন: ইদানীং দেখা যায়, অনেক মা-ই স্তন্যপান করাতে চান না। এ ব্যাপারে কী বলবেন?

এ কথা ঠিক যে, আজকাল অনেক মা নানা কারণে সন্তানকে স্তন্যপান করাতে ইচ্ছুক নন। তারা বাজারচলতি গুঁড়ো দুধ ব্যবহার করেন। এ ক্ষেত্রে মায়ের কোনও সমস্যা থাকলে চিকিৎসককে দেখিয়ে নিয়মিত স্তন্যপান করাতে পারলে ভাল। এতে মায়ের সঙ্গে শিশুর শরীরের সংযোগ ঘটে, যা এটা খুবই জরুরি। বাইরের দুধ ব্যবহারে শিশু অনেকগুলি অসুখের প্রতিষেধক থেকে বঞ্চিত হয়। একান্তই যদি বাইরের দুধ খাওয়াতে হয়, সে ক্ষেত্রে দুধ খাওয়ানোর জন্য যে পাত্র ব্যবহার করা হয়, তা সম্পূর্ণ ভাবে জীবাণুমুক্ত হওয়া দরকার। দুধ খাওয়ানোর সময়ে সতর্কতা অবলম্বন না করলে শিশুর শরীরে নানা ধরনের রোগজীবাণু বাসা বাধতে পারে। তাই সাবধান হওয়া দরকার।

প্রশ্ন: শিশুকে কি জল পান করানো যেতে পারে?

একেবারেই না। শিশুর জন্মের পরে ছ’মাস শুধু মায়ের দুধই যথেষ্ট। কোনও কোনও বাবা-মায়ের এ বিষয়ে ভুল ধারণা থাকে। তারা ভাবেন যে, শিশুকে জল না দিলে হজমে সমস্যা হবে। তারা জানেন না যে, মাতৃদুগ্ধের মধ্যে শতকরা ৮৮ ভাগ জল রয়েছে। এই দুধ থেকেই শিশু প্রয়োজনীয় জল পায়। তাই আলাদা করে জল দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং নির্দিষ্ট বয়সের আগে জল পান করালে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

প্রশ্ন: শিশুরা কোন ধরনের রোগে বেশি আক্রান্ত হয়?

জন্মের পরই বহু শিশুই কম ওজন এবং জন্ডিসের মতো অসুখে ভোগে। তা ছাড়া, শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এমনিতেই কম। তাই ঠিকমতো যত্ন না নিলে নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শ্বাসজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশির সমস্যা হতেই পারে। ঠান্ডা লাগা না কমলে নিউমোনিয়াও হতে পারে। শিশুদের বারবার মুখে হাত দেওয়া, কোনও জিনিস বা খেলনা মুখে দেওয়ার প্রবণতা থাকে। এ সবের মাধ্যমে রোগজীবাণু প্রবেশের সম্ভাবনা থেকে পেটের রোগও দেখা যায় শিশুদের মধ্যে। এ সব ক্ষেত্রে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অবহেলা করলে রোগ জটিল আকার নিতে পারে।

প্রশ্ন: কী ভাবে বোঝা সম্ভব, শিশুর কোনও শারীরিক সমস্যা রয়েছে?

শিশুর কোনও শারীরিক সমস্যা থাকলে, তার প্রাথমিক লক্ষণ হল স্তন্যপানে অনীহা। স্বাভাবিক ভাবে স্তন্যপান করলে বুঝতে হবে শিশু সুস্থ ও স্বাভাবিক রয়েছে। কিন্তু স্তন্যপান করতে না চাইলে বা ঘ্যান ঘ্যান করলে বুঝতে হবে কোনও সমস্যা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। শ্বাস-প্রশ্বাস জোরে হলেও বুঝতে হবে শিশু কোনও শারীরিক সমস্যায় ভুগছে।

প্রশ্ন: শিশুদের অনেক সময়ে ডায়েরিয়ার সমস্যা দেখা যায়। কী ভাবে যত্ন নেওয়া উচিত?

যে সব শিশুদের স্বাস্থ্য সামগ্রিক ভাবে খারাপ, তাঁদের ডায়েরিয়া সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেক বেশি। বিশেষ করে যাদের ওজন স্বভাবিকের তুলনায় কম, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে বড় হয়, মায়ের স্বাস্থ্য ভাল নয়, তাদেরই সমস্যা বেশি দেখা যায়। ডায়েরিয়া হলে অনবরত মলত্যাগের কারণে শরীরে জলের অভাব হলেই বাচ্চা ক্রমশ নেতিয়ে পড়ে। তাই ডায়েরিয়া শুরু হলেই বারে বারে ওআরএস খাওয়ানো বাধ্যতামূলক। দুগ্ধপোষ্য হলে অবশ্যই মায়ের
দুধই দেওয়া উচিত।

রোটা ভাইরাসের কারণে ডায়েরিয়া হলে তা প্রাণঘাতীও হতে পারে। তাই রোটাভাইরাসের টিকা দিয়ে নিলে ভাল হয়। এই টিকা নেওয়া থাকলে রোটা ভাইরাসজনিত ডায়েরিয়ার কারণে হওয়া ৮০ শতাংশ মৃত্যু আটকানো সম্ভব।

প্রশ্ন: মা-বাবা অথবা পরিবারের কারও শ্বাসজনিত সমস্যা থাকলে শিশু কতটা প্রভাবিত হতে পারে?

শ্বাসপীড়া এক ধরনের বংশগত অসুখ। মা, বাবা বা পরিবারে এই ধরনের অসুখ থাকলে শিশুরও ওই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। যে কোনও বংশগত রোগের ক্ষেত্রে এটা সত্য।

প্রশ্ন: শীতকালে কী ভাবে শিশুর যত্ন নিতে হবে ?

লক্ষ রাখতে হবে, যাতে কোনও ভাবেই ঠান্ডা না লাগে। মাথা, কান, হাত, পা ভাল করে মুড়ে রাখতে হবে। ভোরে বা সন্ধের পরে খুব প্রয়োজন না হলে বাইরে না বেরনোই ভাল। তবে শীতের পোশাকের জন্য শিশুর হাঁটাচলা বা শোয়ায় যাতে কোনও সমস্যা না হয়, তা-ও দেখতে হবে।

প্রশ্ন: শিশুর যত্নের ক্ষেত্রে আর কী কী বিষয় গুরুত্বপূর্ণ?

শিশুকে নিয়মিত স্নান করানো দরকার। ত্বক পরিষ্কার রাখতে সাবান, শ্যাম্পু ব্যবহার করা যায়। তবে সর্ষের তেল ব্যবহারে অ্যালার্জির ঝুঁকি বেড়ে যায়। পাশাপাশি, শিশুর ঘুম পর্যাপ্ত হচ্ছে কি না, সে বিষয়েও নজর রাখা জরুরি। কারণ শিশুর ঠিকমতো শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধির জন্য
পর্যাপ্ত ঘুম দরকার।

প্রশ্ন: শিশুর স্বাস্থ্যের সঙ্গে মায়ের যত্ন কী ভাবে জড়িত?

শিশুর যত্ন নিতে গিয়ে অনেক সময়েই আমরা মায়ের স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদাসীন হয়ে যাই। অথচ শিশু মায়ের থেকেই তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায়। তাই শিশুর স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য মায়ের ঠিকমতো পুষ্টি যাতে হয়, তা দেখতে হবে। সময়মতো পুষ্টিকর খাওয়াদাওয়া, ঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, রোগ হলে সত্বর তার চিকিৎসা—এ সব বিষয় মেনে চলতেই হবে।

প্রশ্ন: অনেক সময়েই দেখা যায়, খেলনার পাশাপাশি আজকাল বাবা-মায়েরা শিশুর হাতে মোবাইলও ধরিয়ে দেন। এটা

কতটা সমস্যার হতে পারে?

এমনটা করা একেবারেই উচিত নয়। মোবাইল কখনও খেলনার বিকল্প হতে পারে না। মোবাইল থেকে নির্গত বিকিরণ শিশুর পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। অনেক সময়ে শিশুরা মোবাইলের স্ক্রিনে জিভও ছোঁয়ায়। এর থেকে নানা ধরনের ক্ষতিকর জীবাণু শিশুর শরীরে প্রবেশ করতে পারে।

সাক্ষাৎকার: সমীর দত্ত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন