রোগী দেখছেন চিকিৎসক। ছবি: উদিত সিংহ
প্রশ্ন: বড়দের ক্ষেত্রে হার্টের তো অনেক রকম সমস্যা দেখা যায়। শিশুদের ক্ষেত্রেও কি এই সমস্যা দেখা দিতে পারে?
উত্তর: আমরা অনেকেই ভাবি হার্ট বা হৃদপিণ্ডের সমস্যা শুধু বড়দেরই হতে পারে। একটা বয়সের পরে তাই নিয়মিত চেকআপের পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু শিশুদেরও হার্টের সমস্যা দেখা যায়। বিশেষ করে, সদ্যোজাত শিশুদের মধ্যেও হার্টের বড় রকম সমস্যা দেখা যায়। তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, এখন এই সমস্যার যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে।
প্রশ্ন: শিশুদের হৃদপিণ্ডের সমস্যা কী ধরনের হয়?
উত্তর: শিশুদের ক্ষেত্রে হৃদপিণ্ডের সমস্যা দুই প্রকারের হয়ে থাকে। প্রথমটি হল জন্মগত। আর দ্বিতীয়তটি জন্মের পরে হওয়া সমস্যা।
প্রশ্ন: প্রথমে জন্মগত সমস্যাগুলি নিয়ে যদি কিছু বলেন? এই সমস্যা কী ধরনের হয়?
উত্তর: আগেই বলি হৃদপিণ্ড একটি পেশিবহুল অঙ্গ। দু’টি অলিন্দ এবং দু’টি নিলয়— সব মিলিয়ে হৃদপিণ্ডের চারটি ভাগ। অনেক সময়ে জন্ম নেওয়া শিশুর হৃদপিণ্ডের অনেক রকম গঠনমূলক সমস্যা থেকে যায়। হৃদপিণ্ডের মধ্যে ফুটো থাকা, হৃদপিণ্ডের গঠন ঠিকঠাক না হওয়ার মতো নানা সমস্যা থাকে। এই সমস্যাকে বলা হয়, জন্মগত সমস্যা। এর ফলে হৃদপিণ্ড দিয়ে রক্ত সঞ্চালনের সমস্যা হয়। জন্মের সময়ে শিশুর হৃদপিণ্ডে হওয়া সমস্যাকে টিজিএ বলা হয়। যার পুরো অর্থ ‘ট্রান্স পজিশন অব দ্য গ্রেট’।
প্রশ্ন: জন্মগত সমস্যাগুলি নিয়ে সবিস্তারে বলুন?
উত্তর: শিশুদের জন্মগত হৃদপিণ্ডের সমস্যাকে প্রধানত দু’টি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটিকে বলা হয় সায়ানোটিক। আর দ্বিতীয়টি হল, নন সায়ানোটিক। সায়ানোটিক মানে, আমরা সহজ ভাষায় ব্লু-বেবি বলি। নন সায়ানোটিক, মানে ব্লু বা নীল নয়, কিন্তু এই শিশুদেরও হৃদপিণ্ডে সমস্যা রয়েছে।
প্রশ্ন: এই সমস্যাগুলি কী রকম?
উত্তর: প্রথমেই আসি সায়ানোটিক সমস্যায়। এই সমস্যায়, জন্মের পরেই শিশুর গায়ের রং নীল হতে থাকে। শিশু খেতে পারে না। এমনই অবস্থা হয়ে যে, শিশু মায়ের দুধও পর্যন্ত খেতে পারে না। নন সায়ানোটিক শিশুদের ক্ষেত্রে গায়ের রং পরিবর্তন হয় না। ফলে খুব দ্রুত এই রোগ ধরা পড়ে না। দেড় বা দুই মাস পরে থেকে দেখা যায় শিশুর ওজন বাড়ছে না। খাওয়া কমে যাচ্ছে। খাওয়ার সময় শিশু ঘেমে যাচ্ছে। তখন চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগ ধরা পড়ে।
প্রশ্ন: সায়ানোটিক বা নন সায়ানোটিক রোগের ক্ষেত্রে কি মৃত্যু হতে পারে?
উত্তর: সায়ানোটিক বা নন সায়ানোটিক— দু’টি ক্ষেত্রেই কিন্তু শিশুর মৃত্যু হতে পারে। তবে সায়ানোটিক এর ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি থাকে। অন্য দিকে, নন সায়ানোটিকের ক্ষেত্রে শিশুর নানা শারীরিক সমস্যা দেখা যায়। ফলে ধীরে ধীরে শিশু মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। তবে একটা কথা বলে রাখা যায়, যদি শিশুর পরিবার ঠিক সময়ে চিকিৎসা করায়, তা হলে শিশুকে বাঁচানো সম্ভব।
প্রশ্ন: শিশুদের হৃদপিণ্ডের সমস্যা থেকে আর কী কী সমস্যা দেখা দিতে পারে?
উত্তর: শিশুদের হৃদপিণ্ডের সমস্যার কারণে নানা রোগ হয়। সেগুলি হল—
১) কাওয়াসাকি ডিজ়িজ়: এই রোগ হলে জ্বর হয়। ভাইরাসের সংক্রমণ হলে যেমন জ্বর হয়, এই শিশুদের অনেকটা সেই ধরনের জ্বর আসে। সঙ্গে গা ব্যথা হয়। এর পাশাপাশি, চোখ ও জিভ ভীষণ লাল হয়ে যায়।
২) রিউম্যাটিক হার্ট ডিজ়িজ়: হৃদপিণ্ডের সমস্যার ফলে এই রোগ হয়। এই রোগেরও প্রাথমিক লক্ষণ জ্বর, গা ব্যথা। সঙ্গে হাঁপানি। এই রোগটিই বর্তমানে শিশুদের মধ্যে বেশি হচ্ছে।
৩) মায়ো কাউটিস: এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণও জ্বর ও শ্বাসকষ্ট। যদিও এই রোগের ফলে শরীর নীল হয়, ওজন কমে যায়, খেতে খেতে বাচ্চা হাঁপিয়ে যায়।
প্রশ্ন: শিশুর এই রোগগুলি হলে চিকিৎসা কী ভাবে করতে হবে?
উত্তর: প্রথমেই বলি, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এই রোগগুলির ক্ষেত্রে চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। ওষুধেই এই রোগ ভাল হয়। তবে, এই চিকিৎসা একটু ব্যয়বহুল। তবে সবার আগে যেটা দরকার, তা হল শিশুদের বাবা-মায়েদের আগে হৃদপিণ্ডের সমস্যা সম্পর্কে সতর্ক হতে হবে। লক্ষণগুলি নজরে পড়লে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
প্রশ্ন: শিশুদের জন্মগত হার্টের সমস্যা ও জন্মের পরের হার্টের সমস্যার ক্ষেত্রে কী চিকিৎসা রয়েছে?
উত্তর: হৃদপিণ্ডের সমস্যা সায়ানোটিক ধরনের হলে অস্ত্রোপচার অবশ্যই করাতে হবে। কী ধরনের অস্ত্রোপচার হবে তা চিকিৎসকই ঠিক করবেন। প্রয়োজন মতো কখনও মাইক্রো সার্জারি, কখনও আবার ওপেন সার্জারির মাধ্যমে চিকিৎসা হয়। মোটামুটি জন্মের এক মাসের মধ্যেই অস্ত্রোপচার করে নেওয়া উচিত। জন্মের পরের হার্টের সমস্যার ক্ষেত্রে অনেক সময় মাইক্রো সার্জারি করা হয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওষুধে কাজ হয়।
প্রশ্ন: চিকিৎসায় শিশুদের হার্টের সমস্যা কি ১০০ শতাংশ সেরে যাওয়া সম্ভব?
উত্তর: অবশ্যই। যদি ঠিক সময়ে চিকিৎসা করানো যায়, তা হলে চিকিৎসায় শিশুর ১০০ শতাংশ সেরে ওঠা সম্ভব। তবে জন্মগত সমস্যার ক্ষেত্রে একটু ঝুঁকি থাকে। তবে ঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু হলে তা ১০০ শতাংশ সেরে যাওয়া সম্ভব।
প্রশ্ন: চিকিৎসার পরে শিশু কি একেবারে সুস্থ জীবনযাপন করতে পারবে? কোনও বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে কি?
উত্তর: আগেই বলেছি, ঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু হলে শিশু সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে। সুস্থ হওয়ার পরে শিশু স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে। তবে জ্বর বা অন্য কোনও সমস্যা হলে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।
প্রশ্ন: শৈশবে হৃদপিণ্ডের ফুটো ধরা পড়ল না। বড় হওয়ার পরে ফুটো ধরা পড়ল। এমন হতে পারে কি? এ ক্ষেত্রে কি চিকিৎসা সম্ভব?
উত্তর: হ্যাঁ এটা সম্ভব। তবে শৈশবে ঠিকমতো পরীক্ষা করালে, কিন্তু সমস্যা ধরা পড়ে যাওয়া উচিত। বড় অবস্থায় সমস্যা ধরা পড়লেও তার চিকিৎসা আছে।
প্রশ্ন: হৃদপিণ্ডে ফুটো থাকার সমস্যা কি জন্মগত?
উত্তর: না। এই সমস্যাটি বংশগত নয়। হঠাৎ করেই কোনও পরিবারে এই রোগ দেখা দিতে পারে।
প্রশ্ন: সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরে কি সমস্যা হতে পারে?
উত্তর: যদি জীবনযাত্রা ঠিক থাকে তা হলে সমস্যা খুব একটা হয় না।
প্রশ্ন: সে ক্ষেত্রে কী কী এড়িয়ে যেতে হবে?
উত্তর: যারা জন্মগত ভাবে হার্টের সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে একটু জ্বর বা সর্দি হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। একই সঙ্গে হার্ড গেম— যেমন ভলি, বাক্সেটবল, ক্রিকেট ইত্যাদি খেলা থেকে দূরে থাকতে হবে।
প্রশ্ন: এই রোগের ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা কেমন?
উত্তর: ‘শিশু সাথী’ থেকে শুরু করে নানা সরকারি প্রকল্প রয়েছে। তাতে বাচ্চারা সুবিধা পাচ্ছে। সরকারি হাসপাতালেও পরিকাঠামো রয়েছে। আর যেখানেই সেই পরিকাঠামো নেই, সেখানে বেসরকারি হাসপাতাল সুবিধা দিচ্ছে।
প্রশ্ন: বর্ধমানে শিশুদের হার্টের সমস্যার হার কেমন?
উত্তর: শুধু বর্ধমান নয়, গোটা বিশ্বে এই রোগ হচ্ছে, বর্ধমানেও হচ্ছে।
প্রশ্ন: জন্মের আগে কি এই বিষয়ে কোন সতর্কতা নেওয়া যেতে পারে?
উত্তর: জন্মের আগে ‘ফিটাল ইকো কার্ডিওগ্রাফি’ করানো হয়। এ ক্ষেত্রে আগে থেকে বোঝা সম্ভব যে, গর্ভস্থ ভ্রুণের কোনও হার্টের সমস্যা রয়েছে কি না। যদিও দেখা যায়, গর্ভস্থ ভ্রুণটি বড় কোনও হার্টের সমস্যা নিয়ে জন্মাচ্ছে, তা হলে ওই পরিবারের সঙ্গে কথা বলে সেই ভ্রুণ নষ্ট করে দেওয়া হয়। নষ্ট না করা হলেও, জন্মানোর পরের মুহুর্তেই সেই শিশুর চিকিৎসা শুরু করা হয়।
প্রশ্ন: কত দিন আগে এই পরীক্ষা করানো যাবে?
উত্তর: জন্মানোর ২০ সপ্তাহ আগে এই পরীক্ষা করানো হয়।
প্রশ্ন: শিশুদের এই হার্টের সমস্যা নিয়ে কি সচেতনতার অভাব রয়েছে?
উত্তর: হ্যাঁ, রয়েছে। এই বিষয়ে সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। অন্যান্য রোগ নিয়ে যেমন লাগাতার প্রচার হয়, এই রোগ নিয়েও ভীষণ ভাবে প্রচার প্রয়োজন।
সাক্ষাৎকার: সুপ্রকাশ চৌধুরী