সোশ্যাল মিডিয়ার জেরে কি টান পড়ছে আবেগে?

লেখক স্মরণজিৎ চক্রবর্তী দ্রুত যোগাযোগ এবং প্রয়োজনে সাহায্য মেলার মতো সুবিধার কথা মানলেও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করেন। তিনি জানাচ্ছেন, চায়ের দোকানে, পাড়ার রকের হারিয়ে যাওয়া আড্ডায় চলত নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা। সমবয়সি তো বটেই, অসম বয়সি মানুষদের মধ্যেও গড়ে উঠত বন্ধুত্ব।

Advertisement

সুনীতা কোলে

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৯ ০৪:১৫
Share:

আনন্দ-দুঃখ-ক্ষোভ — এখন সব আবেগেরই বিস্ফোরণ ঘটে সোশ্যাল মিডিয়ায়। কিছু ঘটলে বহু মানুষই প্রথম প্রতিক্রিয়া প্রকাশের জন্য পছন্দ করেন এই মাধ্যম। কিন্তু, সর্বত্র সোশ্যাল মিডিয়ার এই উপস্থিতি তো বেড়েছে গত কয়েক বছরে। আগে কি তা হলে মানুষ আবেগ প্রকাশ করত না? সোশ্যাল মিডিয়ার আগে কী ভাবে চলত ভাবনার আদানপ্রদান?

Advertisement

লেখক স্মরণজিৎ চক্রবর্তী দ্রুত যোগাযোগ এবং প্রয়োজনে সাহায্য মেলার মতো সুবিধার কথা মানলেও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করেন। তিনি জানাচ্ছেন, চায়ের দোকানে, পাড়ার রকের হারিয়ে যাওয়া আড্ডায় চলত নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা। সমবয়সি তো বটেই, অসম বয়সি মানুষদের মধ্যেও গড়ে উঠত বন্ধুত্ব। স্মরণজিৎ বলেন, ‘‘এখন তো একসঙ্গে বসে থাকলেও চোখ থাকে স্মার্টফোনের দিকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্য রকম হতে চাওয়ার ইচ্ছে থেকে বাড়ছে অসুখী হওয়ার ঘটনা। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সম্পর্ক।’’

তবে আর এক দিকে সম্পর্ক তৈরি করতেও কি অনুঘটক হয়ে উঠছে না সোশ্যাল মিডিয়া? বাচিক-শিল্পী ঊর্মিমালা বসু যেমন বলছেন সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে পাওয়া বন্ধুদের কথা। মুখোমুখি দেখা না হলেও তাঁরা হয়ে উঠছেন প্রিয়। যদিও তিনি মনে করেন, সোশ্যাল মিডিয়া এসে বিরহ ঘুচিয়ে দিয়েছে। ঊর্মিমালার কথায়, ‘‘আগে প্রিয়জনের অনুপস্থিতিতে নিজেকে চেনা যেত ভাল করে। এখন ভাল লাগা, মন্দ লাগার তাৎক্ষণিক প্রকাশ ঘটে সোশ্যাল মিডিয়ায়।’’

Advertisement

খাঁটি আবেগের প্রকাশ কি তা হলে হারিয়ে গেল? তা না হলে পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও গিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়ার জন্য ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে কেন? সকলের সঙ্গে সব ভাগ করে নিতে গিয়ে কি হারিয়ে যাচ্ছে ব্যক্তিগত পরিসরটাই?

তাৎক্ষণিক শেয়ার করার প্রবণতা আবেগকে পিছনে ফেলে দিয়েছে বলেই মনে করেন তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী দেবজিতা দত্ত। তিনি বলেন, ‘‘আগে কোনও বিশেষ খবর আলাদা করে প্রিয়জনেদের জানানো হত। এখন অনেকেই তা সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান। সেখানে ইমোটিকন-সহ মন্তব্য বা লাইকের বন্যা বইলেও তাতে নিখাদ ভাল লাগা বা শুভেচ্ছা কতটা থাকে?’’

শিক্ষিকা সাগরিকা ঘোষ সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত ছবি শেয়ার করেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘সকলেই এখন ব্যস্ত। আগে যে জিনিসটা ফোন করে বা দেখা হলে জানাতাম, এখন সেটাই সোশ্যাল মিডিয়ায় দিই। যাঁরা দেখার, তাঁরা ঠিকই দেখেন। তেমন ব্যক্তিগত বিষয় অবশ্য শেয়ার করি না।’’ কিছু জানাতে আগে চিঠি লেখা বা মুখোমুখি আলোচনার আশ্রয় নিতেন বছর ঊনত্রিশের সরকারি চাকুরে অরুণিমা দাস। তিনি বলেন, ‘‘সোশ্যাল মিডিয়া আসার প্রথম দিকেও কিন্তু বিষয়টা অনেকটাই ব্যক্তিগত ছিল। আলাদা আলাদা করে চ্যাট করতেই পছন্দ করতেন অধিকাংশ মানুষ। এখন শেয়ার করার মানসিকতাই বেশি দেখা যাচ্ছে।’’

হেনস্থা, হিংসা, গুজব ছড়ানোয় বারবার অভিযুক্ত হচ্ছে এই মাধ্যম। সম্প্রতি কাশ্মীরে জঙ্গি হানার পরে পোস্ট করার জেরে ঘটেছে বেশ কিছু অনভিপ্রেত ঘটনাও। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, এই ধরনের ঘটনা ঘটলে তা নিয়ে আগে আলোচনা হত চে‌নাজানা পরিসরের মধ্যে। কেউ কেউ হয়তো বিতর্কিত মন্তব্যও করতেন। কিন্তু তেমন মত এখন সোশ্যাল মিডিয়ার হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ছে মুর্হূতের মধ্যে, যা খুবই উদ্বেগজনক।

সমাজতত্ত্বের শিক্ষক প্রশান্ত রায়ের মতে, নিজের কথা অন্যদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ইচ্ছে মানুষের মধ্যে চিরকালই ছিল। সোশ্যাল মিডিয়া এসে সেই ইচ্ছেটা শুধু বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘আসল বিষয়টি একই আছে। মাধ্যমের পরিবর্তন ঘটেছে শুধু।’’কিন্তু সেই ইচ্ছেতে কিছুটা রাশ না টানলে কি বিপদের আশঙ্কা থাকে?

এ ক্ষেত্রে ঊর্মিমালার ভোট সচেতন ভাবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করার পক্ষে। তিনি বলেন, ‘‘সচেতনতা কিন্তু আগে যতটা দরকারি ছিল, এখনও ঠিক ততটাই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন