উপসর্গ পাল্টে ফের কলকাতায় হাজির মশাবাহিত দুই রোগ— ডেঙ্গি ও ম্যালেরিয়া। বিষয়টি নিয়ে চিকিৎসকেরা উদ্বিগ্ন হলেও গুরুত্ব দিতে নারাজ কলকাতা পুরসভা।
জীবাণু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন উপসর্গ নিয়ে ডেঙ্গির এই ফিরে আসাটা ২০১২ সালের সংক্রমণকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। সে বার নতুন উপসর্গ দেখে রোগ চিনতে দেরি হওয়ায় মৃত্যু হয়েছিল বহু মানুষের। ডেঙ্গি পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়।
জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে পেটের অসুখ ছিল ২০১২ সালে ডেঙ্গির নতুন উপসর্গ। ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়ার মতো রোগীদের লিভারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছিল চটপট। কলকাতার যে সব চিকিৎসক এ বার ডেঙ্গি রোগীদের চিকিৎসা করছেন, তাঁদের অনেকেই প্রাথমিক উপসর্গ দেখে রোগ চিনতে পারছেন না। স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা অমিতাভ নন্দী বলেন, ‘‘গত তিন বছর নতুন যে উপসর্গটি ধরা পড়েছিল, তাতে জ্বরের পরে রোগীদের পেট খারাপ হচ্ছিল। এ বার জ্বর হচ্ছে পেট খারাপের পরে। ছোট ছোট ফোস্কার মতো র্যাশ বেরোচ্ছে গায়ে। তখনই রক্ত পরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে
ডেঙ্গি পজিটিভ।’’
চিকিৎসক প্রবীর বিশ্বাস গত সাত দিনে চার জন রোগীর রক্ত পরীক্ষা করিয়ে ডেঙ্গি পজিটিভ পেয়েছেন। প্রবীরবাবুর মন্তব্য, ‘‘আমি যে চার জন ডেঙ্গি রোগীর চিকিৎসা করছি, তাঁদের সবারই লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে দু’জনের লিভার এতটাই খারাপ হয়েছে যে তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছে।’’ অমিতাভবাবু, প্রবীরবাবুরা অবশ্য এখনও পর্যন্ত কোনও রোগীর রক্তেই হেমারেজিক ডেঙ্গি (যে ধরনের ডেঙ্গিতে রক্তপাত হয়)-র জীবাণু পাননি বলে জানিয়েছেন।
স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের আর এক প্রাক্তন অধিকর্তা অমিয়কুমার হাটি অবশ্য বেশি চিন্তিত ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ নিয়ে। অমিয়বাবু বলেন, ‘‘গত এক মাসে আমার কাছে যে সব রোগী ম্যালেরিয়ার উপসর্গ নিয়ে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে ৬২ জনের রক্তে মিলেছে প্লাসমোডিয়াম ভাইভ্যাক্সের জীবাণু। ২৩ জনের রক্তে পাওয়া গিয়েছে ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম।’’ তাঁর কাছে অগস্ট মাসে চিকিৎসা করাতে আসা ছয় জন রোগীর রক্তে ডেঙ্গির জীবাণুও মিলেছে বলে অমিয়বাবু জানিয়েছেন।
ট্রপিক্যালের ম্যালেরিয়া ক্লিনিকের প্রাক্তন প্রধান অমিতাভ নন্দীও ডেঙ্গির পাশাপাশি এ বার ম্যালেরিয়া সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি নিয়ে চিন্তিত। অমিতাভবাবু বলেন, ‘‘গত দু’বছর তেমন ফ্যালসিপেরামের রোগী পাইনি। এ বার কিন্তু প্রথম থেকেই ফ্যালসিপেরামের রোগীর সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে।’’ শুধু তাই নয়, এ বার প্রথম থেকেই ওষুধ-প্রতিরোধী ম্যালেরিয়া রোগীর সন্ধান মেলায় চিন্তিত চিকিৎসকেরা।
তবে পরজীবী বিশেষজ্ঞদের এ হেন শঙ্কার কোনও ভিত্তিই খুঁজে পাচ্ছে না কলকাতা পুরসভা। এ বছর এখনও পর্যন্ত ডেঙ্গির জীবাণুবাহী ইডিস ইজিপ্টাই মশার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই রয়েছে বলে দাবি পুর প্রশাসনের। পুরসভার স্বাস্থ্য দফতরের এক আধিকারিক জানান, জানুয়ারি থেকেই শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে মশার বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছেন স্বাস্থ্য কর্মীরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন মেনে শহরের নানা এলাকায় জমা জলে ডেঙ্গি ও ম্যালেরিয়াবাহী মশার লার্ভার সন্ধানে ঘুরছে পুরকর্মীরা। স্বাস্থ্য দফতরের মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষের দাবি, গত বছরে এই সময়ের মধ্যে শহরে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের রিপোর্ট মিলিয়ে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন প্রায় সাড়ে ন’শো জন। সেই তুলনায় এ বার শহরে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছে মাত্র ৩৩ জন। তিনি জানান, সব চেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে। উল্টোডাঙা সংলগ্ন ওই এলাকায় বাইরে থেকে আসা লোকেদের থেকেও ওই রোগের সংক্রমণ হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করেন অতীনবাবু। এ ছাড়া দক্ষিণ কলকাতায় ১১৭, ১১৬, ১০৪ এবং উত্তর কলকাতার ৬ ও ১০ নম্বর ওয়ার্ডে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন একাধিক বাসিন্দা।