বিশ্বজিৎ কর। রবিবার রোগের বলি।
এ যেন বিলকুল অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানো!
রোগের উৎস জানা নেই। রোগের মূলে কোনও ভাইরাস নাকি ব্যাক্টেরিয়া নাকি অন্য কোনও জীবাণু, তা বার করা যায়নি। এমনকী, কীসের মাধ্যমে এটা ছড়াচ্ছে, তা-ও অজানা। ফলে প্রতিরোধ ও চিকিৎসার পথ মেলেনি। শুধু জানা গিয়েছে রোগটা সংক্রামক, তাতে আক্রান্তের মস্তিষ্ক ফুলে যাচ্ছে। জ্বর, খিঁচুনি হচ্ছে। শেষে রোগী সংজ্ঞা হারাচ্ছেন। অনেকে মারাও যাচ্ছেন। যেমন রবিবার সকালে দমদম মিউনিসিপ্যাল হাসপাতালে মারা গেলেন কাঁচরাপাড়ার বিশ্বজিৎ কর (৫২)।
রোগটির নাম অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস সিনড্রোম, সংক্ষেপে এইএস (এনসেফ্যালন, অর্থাৎ মস্তিষ্কের অংশ ফুলিয়ে দেয় বলে এনসেফ্যালাইটিস)। অসম, উত্তরবঙ্গ দাপিয়ে এই রোগ এখন ঢুকে পড়েছে দক্ষিণবঙ্গে। উত্তরবঙ্গ ও অসমে গত ক’মাসে এই ধরনের জ্বর ও এনসেফ্যালাইটিস সংক্রমণ সহস্রাধিক প্রাণ কেড়েছে। রবিবার বিকেলে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আরও এক জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর নাম দীপ্তি বর্মন (৩৪)। বাড়ি দক্ষিণ দিনাজপুরে। অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস সিনড্রোম নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি।
সমস্যা হল মৃতদের রক্ত ও সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড (সিএসএফ)-এ জাপানি এনসেফ্যালাইটিস কিংবা অন্য রোগ-জীবাণু মেলেনি। ডাক্তারেরা ডেথ সার্টিফিকেটে মত্যুর কারণ হিসেবে শুধু লিখতে পারছেন, অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস সিনড্রোম। পুণের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি এবং দিল্লির ইনস্টিটিউট অফ কমিউনিকেবল ডিজিজেস-এর জীবাণু-বিজ্ঞানীরা উত্তরবঙ্গ থেকে রোগীদের দেহরসের নমুনা নিয়ে গিয়েছেন। তাঁরাও সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি।
কাঁচরাপাড়ার বিশ্বজিৎবাবুও ওই অজানা রোগের শিকার। গত ২৪ জুলাই তাঁর জ্বর এসেছিল। ২৭ জুলাই রাতে জ্বর বাড়ে, সঙ্গে খিঁচুনি। কল্যাণীর জওহরলাল নেহরু মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিজনেরা জানিয়েছেন, সেখানে তাঁদের বলা হয় রোগীকে কলকাতায় নিয়ে যেতে। বিশ্বজিৎবাবুর ভাই পার্থ কর ওঁকে দমদম মিউনিসিপ্যাল হাসপাতালে ভর্তি করেন। ২৮ জুলাই থেকে ভেন্টিলেশনে ছিলেন। এক-এক করে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জবাব দিতে থাকে। এ দিন সকালে সব শেষ। বিশ্বজিৎবাবুর চিকিৎসক আনন্দ বাগচীর কথায়, “ওঁর শরীরে জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের জীবাণু মেলেনি। তবে উপসর্গ সব এনসেফ্যালাইটিসের। রোগটাকে এক ধরনের ভাইরাল এনসেফ্যালাইটিস সংক্রমণ বলা যেতে পারে।”
এর আগে এইএসে কলকাতায় দু’টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে ও কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। ন্যাশনালে মৃত প্রান্তিক রায়ের ডেথ সার্টিফিকেটে রক্ত পরীক্ষা ছাড়াই স্রেফ ক্লিনিক্যাল পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে মৃত্যুর কারণ ‘এইএস’ লেখা হয়েছিল, যা নিয়ে শোরগোল কম হয়নি। তবে ঘটনা হল, প্রান্তিকও রোগটা কল্যাণী থেকে নিয়ে আসে বলে পরিবারের দাবি। এমনকী, তার বাবাও এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে এসএসকেএমে ভর্তি ছিলেন। বিশ্বজিৎবাবুর মৃত্যুর প্রেক্ষিতে কল্যাণী-কাঁচড়াপাড়া এলাকায় বিশেষ নজর দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন জীবাণু-বিজ্ঞানীরা।
ওই তল্লাটে চিকিৎসার হাল কেমন? কল্যাণীর জওহরলাল নেহরু হাসপাতাল সম্পর্কে ক্ষোভ উগরে দেন বিশ্বজিৎবাবুর আত্মীয়েরা। ওঁদের অভিযোগ: হাসপাতালটি মেডিক্যাল কলেজে উন্নীত হওয়ার পরে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। কোনও জটিল রোগের চিকিৎসা সেখানে হয় না। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে মন্তব্য না-করলেও সেখানকার এক ডাক্তারের যুক্তি, “আমরা ওঁর উপসর্গ দেখে চিকিৎসা করছিলাম। রোগী তাতে সাড়া দেননি। অবস্থা খারাপ হওয়ায় ঝুঁকি নিতে পারিনি। কলকাতায় পাঠাতে বলি।” ওঁর আক্ষেপ, “বিশ্বজিৎবাবুর ভেন্টিলেটর দরকার ছিল। সেটাও তো আমাদের নেই!”
বস্তুত এইএস-অধ্যুষিত এলাকায় ডাক্তারেরা যে কতটা অসহায়, কল্যাণীর ওই চিকিৎসকের মন্তব্যে তারই ছায়া দেখছেন অনেকে। উপসর্গ ভিত্তিক চিকিৎসার যথার্থ পরিকাঠামোও বহু জায়গায় না-থাকায় প্রাথমিক ধাক্কাটাই সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। রোগের কারণ বা উৎস চিহ্নিত না-হওয়ায় সরকার কার্যত অকূল পাথারে। নিজেদের অসহায়তা প্রকাশ করে স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলছেন, “পুণে, দিল্লির বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, পানীয় জল মারফত রোগ ছড়াতে পারে। তাই ওঁরা পরিস্রুত জল সরবরাহে জোর দিয়েছেন। এর বেশি কিছু ওঁরাও জানাতে পারেননি।” এখানকার বিশেষজ্ঞদের কী অভিমত?
কলকাতার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ভাইরোলজি-র গবেষকদের দাবি: কলকাতা ও আশপাশে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস (জেই) ছড়ানোর আশঙ্কা কম। কারণ জেই-র জীবাণু বহন করে যে কিউলেক্স বিশনোই মশা, মহানগরের পরিমণ্ডল তার বংশবৃদ্ধির পক্ষে অনুকূল নয়। কিন্তু উত্তরবঙ্গ থেকে ক্রমশ দক্ষিণে আসা অজানা রোগটিকে ঠেকানোর উপায় সম্পর্কে তাঁরাও অন্ধকারে। পরজীবী-বিশেষজ্ঞ তথা চিকিৎসক অমিতাভ নন্দীর কথায়, “কলকাতাতেও কিছু এনসেফ্যালাইটিসের রোগী পাই। কারও হয়তো মেনিঙ্গো এনসেফ্যালাইটিস ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়া থেকে রোগটা হয়েছে। কারও হারপিস জীবাণু থেকে। ম্যালেরিয়া থেকেও এনসেফ্যালাইটিস হচ্ছে।” ওঁর বক্তব্য, এই সব ক্ষেত্রে রোগের উৎস জানা থাকায় চিকিৎসা করতে সুবিধা হয়। “কিন্তু উত্তরবঙ্গ বা অসমে ব্যাপক ভাবে যা ছড়িয়েছে, সেই রোগটির কারণ অজানা থেকে যাওয়ায় চিকিৎসা ও প্রতিরোধে সমস্যা তৈরি হচ্ছে।” বলছেন ট্রপিক্যালের প্রাক্তন অধিকর্তা অমিতাভবাবু।
স্বাস্থ্যভবন সূত্রেই অভিযোগ, উত্তরবঙ্গে রোগের দাপট সম্পর্কে স্বাস্থ্য দফতর তথ্য চেপে গিয়েছিল। তাই রোগ নির্ণয় ও নিরাময়, কোনওটাই ঠিকঠাক হয়নি। এ জন্য উত্তরবঙ্গের চার স্বাস্থ্য-কর্তাকে সাসপেন্ড করেছে নবান্ন, বদলি করা হয়েছে ১৬ জনকে। এখন দক্ষিণবঙ্গে রোগের আঁচ মালুম হওয়ার পরে সরকার কতটা হুঁশিয়ার?
রোগের কারণ জানা না-থাকায় নির্দিষ্ট কোনও কর্মসূচি নেই। আপাতত প্রচারেই ভরসা রাখছে প্রশাসন। পাশাপাশি, নতুন সঙ্কটে মশার ভূমিকা প্রমাণিত না-হলেও মশানিধনে জোর দেওয়া হচ্ছে। “বিভিন্ন পুর-এলাকায় মাইকে প্রচার চলছে। হোর্ডিং দেওয়া হচ্ছে। মশার কামড় এড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।” এ দিন বলেন রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মন্তব্য, “সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। মশাবাহিত এত রোগের রমরমা দেখেও তো অনেকে বাড়িতে জল জমাচ্ছেন!” স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “মানুষকে সতর্ক করাটা জরুরি। দুটো মাস খুব সাবধান থাকতে হবে।”
শত্রু কে, তা-ই জানা নেই। শত্রু বধের অস্ত্রও তাই নাগালের বাইরে। এমতাবস্থায় সাধারণ সতর্কতা অবলম্বন ছাড়া উপায় কী?