খুশির নয়া নেশা, ‘আমাকে দেখুন’

কিস্সা ১। ছুটির দুপুরে বেড়াতে বেরিয়েছেন স্বামী-স্ত্রী। বয়স তিরিশের কোঠায়। বিশাল লেন্স স্ত্রীর দিকে তাক করা। ‘সাবজেক্ট’-এর মুখেও চওড়া হাসি, সিনেমার নায়িকার কায়দায় বেঁকিয়ে ধরা স্কার্ট। ক্লিক হতে না হতেই ছুটে এলেন তরুণী। খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘‘একী, স্কার্টটাই তো ভাল এল না!’’ স্বামীর মুখও তৎক্ষণাৎ কাঁচুমাচু।

Advertisement

পরমা দাশগুপ্ত ও সুচন্দ্রা ঘটক

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৬ ০২:৪৫
Share:

কিস্সা ১। ছুটির দুপুরে বেড়াতে বেরিয়েছেন স্বামী-স্ত্রী। বয়স তিরিশের কোঠায়। বিশাল লেন্স স্ত্রীর দিকে তাক করা। ‘সাবজেক্ট’-এর মুখেও চওড়া হাসি, সিনেমার নায়িকার কায়দায় বেঁকিয়ে ধরা স্কার্ট। ক্লিক হতে না হতেই ছুটে এলেন তরুণী। খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘‘একী, স্কার্টটাই তো ভাল এল না!’’ স্বামীর মুখও তৎক্ষণাৎ কাঁচুমাচু। তার পরেই অবশ্য অ্যাকশন রিপ্লে। ফেসবুকে কি আর রাগী মুখের ছবি মানায়!

Advertisement

কিস্‌সা ২। দামি রেস্তোরাঁয় চার বন্ধু। অনেক দিন পরে দেখা। খাবারের প্লেট আসতেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন সকলে। খেতে নয়। একের পর এক ফ্ল্যাশের ঝলকানি। শেষমেশ উঠে এলেন খোদ ম্যানেজারই। খানিকটা অস্বস্তি ভরা মুখেই বললেন, ‘‘খাবারগুলো আসলে ঠান্ডা হয়ে গেলে আর ভাল লাগবেনা। তাই...।’’

কিস্সা ৩। কয়েক লক্ষ গচ্চা দিয়ে কম্বোডিয়া-ভিয়েতনাম পাড়ি দিচ্ছেন নবীন দম্পতি। ইতিহাসে টান? নাঃ, এক্কেবারেই নেই। তা হলে যাচ্ছেন কেন? ‘রুইন্‌স’-এর মাঝে প্রোফাইল পিক দারুণ আসে যে! ইতিমধ্যেই ও-দেশ বেরিয়ে আসা বেশ কয়েক জন বন্ধুর ফেসবুক অ্যালবাম ঘেঁটে ফেলেছেন। একই কারণে লাদাখ ঘুরেও তো প্রমাণ পেয়েছেন!

Advertisement

কিস্সা ৪। আন্দামানের নীল দ্বীপে হাজির কলকাতার বড় দল। তখন সূর্যাস্ত হবে হবে। চোখ ফেরাতে পারছেন না কেউই। পঞ্চাশোর্ধ্ব বাবা হঠাৎ খেয়াল করলেন মেয়ের চোখ সেঁটে আছে মোবাইল-স্ক্রিনে — আরে, চোখ মেলে দেখ!! মোবাইল পরে দেখবি! মেয়ের সটান জবাব, ‘‘ছবি তুলছি তো!’’ ক্যামেরায় তোল না! ‘‘এখানে আবার ডাউনলোড করব কোথায়! ফোন থেকে তো এক্ষুনি ইনস্টাগ্রামে দেওয়া যাবে!’’ হতবাক বাবা তাকিয়ে থাকেন শুধু।

আশ্চর্য হওয়া কি আর অস্বাভাবিক?

প্রতি মুহূর্তকে ছবিতে ‘দেখানো’র এই হিড়িক দেখে একটু বড়রাও তো প্রশ্ন তুলছেন, বদলে যাওয়া আনন্দের সংজ্ঞা কি তবে এটাই?

রেস্তোরাঁয় পেটপুজো হোক বা বন্ধুদের আড্ডা, সদলবলে বেড়াতে যাওয়াই হোক বা সপ্তাহান্তের মল-ভ্রমণ— ছবি তোলাটাই আসল কথা। এবং তুলতে না তুলতেই খানিক এডিট হয়ে সটান সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে। ১০ থেকে ৩০ বছরের স্মার্টফোন-প্রজন্ম এতেই বিশ্বাসী। যা দেখে ভ্রূ কোঁচকাচ্ছেন এমনকী পঁয়ত্রিশ ছুঁইছুঁই-রাও। বলছেন, আড্ডাটা ওরা মারে কখন? কখন-ই বা খায়? আরও এক ধাপ এগিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলে ফেলছেন, ‘‘বেড়াতে বা রেস্তোরাঁয় যাওয়াও কি তবে ফেসবুকে ছবি দিতে হবে বলেই?’’

সাক্ষী তো রেস্তোরাঁগুলোও। দক্ষিণ কলকাতার এক নামী রেস্তোরাঁর কর্তা যেমন বলছেন, ‘‘কখনও কখনও এমনও হয়, ওয়েটারকে আটকে রেখে চলে সেলফি আর ফোটো-সেশন। সেটা দীর্ঘক্ষণ ধরে চলতে থাকলে আমরা বারণ করতে বাধ্য তো হই। ছবি তোলার চল তো সব সময়েই ছিল। কমবয়সীদের দেখছি ছবির ঝোঁকটাই বেশি।’’ সদ্য এক রেস্তোরাঁর খাদ্য উৎসবের অভিজ্ঞতার পরে চল্লিশ পেরোনো ইঞ্জিনিয়ার অনির্বাণ বসু আবার বলেই ফেললেন, ‘‘জনা পাঁচেক কিশোর-কিশোরী এসেছিল। তাদের টেবিলে দেখি প্রায় দশ জনের খাবার। সাজানোগোছানো খাবারে ভরা টেবিলের ছবি ভাল আসে বলেই নাকি, কে জানে!’’ শহরের আর এক নামী রেস্তোরাঁর কর্তা অবশ্য ইতিবাচক দিকটাকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন বেশি। তাঁর কথায়, ‘‘ছবি তোলার ঝোঁক বেড়েছে ঠিকই। তবে খাবারগুলো পছন্দ হচ্ছে বলেই তো ছবি তুলে রাখছে!’’

কিন্তু প্রশ্ন একটা থাকেই।

সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ছবিই কি তবে পৃথিবী হয়ে উঠছে এ প্রজন্মের?

গোটা জিনিসটাকে আত্মবিপণনের প্রবণতা বলেই মনে করছেন সমাজতাত্ত্বিক রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর মতে, ‘‘সর্বক্ষণ বিপণনের মধ্যে থাকতে থাকতে নিজেকেও প্রোডাক্ট ভেবে ফেলছে ছেলেমেয়েরা। ফলে নিজেকে ডিসপ্লে করাটা জরুরি হয়ে পড়ছে। প্রযুক্তি তার ব্যবস্থাও করে দিয়েছে। অন্য দিকে রোজকার জীবনযাপনে বাড়তে থাকা একাকীত্বের জেরে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে অনেক বেশি সক্রিয় থাকছে এখনকার প্রজন্ম। হিমালয়ের সৌন্দর্য নিজের ভাল লাগার জন্য উপভোগ করার চেয়ে অন্যকে দেখানো এবং তাদের চোখে গুরুত্ব পাওয়াকে বেশি প্রাধান্য
দিচ্ছে ওরা।’’

আর মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘ছবি তোলা তো নয়, আপলোডটাই আসল। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ছবি পোস্ট করা মানে পৃথিবীসুদ্ধ লোককে দেখিয়ে দেওয়া যাচ্ছে— কী খাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি, কাদের সঙ্গে, কতটা আনন্দ করছি। তাতে ক’টা লাইক পড়ল, কী কমেন্ট এল— অন্যের মূল্যায়নের উপরেই যেন আমার জীবনযাপন মান্যতা পাচ্ছে। কিন্তু নিজের আনন্দ নিয়ে তো নিজের আত্মবিশ্বাসী হওয়ার কথা। অন্যরা কী বলল, তার উপরে নির্ভর করা মানে তা হলে নিজের ভাল থাকা নিয়ে নিজেই সংশয়ে থাকা। কিংবা আমি কতটা আনন্দে আছি, তা জাহির করে নিজের জীবনের কোনও শূন্যতা ঢাকা দিতে চাওয়া।’’

তা হলে আনন্দ, তুমি কি কেবলই ছবি? প্রশ্ন এখন সেটাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন