গর্ভপাত নিয়ে ছুতমার্গ আদৌ কেটেছে কি

সন্তানের জন্ম দেওয়া বা না দেওয়ায় নারীর স্বাধীনতার কথা মানে শহুরে বাঙালি? কী বলছেন সাধারণ মানুষ এবং বিশেষজ্ঞেরা?

Advertisement

সুচন্দ্রা ঘটক

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৭ ১৩:০০
Share:

গর্ভপাতের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে আদৌ কতটা উদার হয়েছে চারপাশটা? প্রতীকী ছবি।

ভ্রূণের বয়স ২৬ সপ্তাহ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সম্প্রতি গর্ভপাতের অনুমতি পেয়েছেন বারাসতের এক দম্পতি। সন্তান প্রসব করা বা না করা নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার বলেও এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু এ তো গেল আইনের কথা। আইন যতই এগোক, এগিয়েছে কি সমাজ? গর্ভপাতের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে আদৌ কতটা উদার হয়েছে চারপাশটা? সচেতনতাই বা বেড়েছে কত? এত পরিবর্তনের পরেও কি গর্ভপাত সহজে মেনে নিতে পারেন অধিকাংশ মানুষ? সত্যিই কি

Advertisement

সন্তানের জন্ম দেওয়া বা না দেওয়ায় নারীর স্বাধীনতার কথা মানে শহুরে বাঙালি? কী বলছেন সাধারণ মানুষ এবং বিশেষজ্ঞেরা?

সম্প্রতি এ বিষয় নিয়ে হওয়া এক সমীক্ষায় বেরিয়ে এসেছে, আগের তুলনায় বেশ খানিকটাই কেটেছে গর্ভপাত নিয়ে ছুতমার্গ। তবে তার সঙ্গে বিশেষ যোগ নেই নারী স্বাধীনতার। এ দেশের গর্ভপাত সংক্রান্ত আইনে যতই বলা থাক, এই সিদ্ধান্তে মা-ই শেষ কথা। বাস্তব পরিস্থিতি মোটেও তা বলছে না। বরং অধিকংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, এ সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করেন অন্তঃসত্ত্বার পরিবার-পরিজনেরাই। ১৯৭১ সালে তৈরি মেডিক্যাল টার্মিনেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী, ভ্রূণের ২০ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত গর্ভপাত আইনসিদ্ধ। যদি দেখা যায় প্রসবের ক্ষেত্রে মায়ের শারীরিক বা মানসিক সমস্যা হতে পারে কিংবা সন্তান কোনও জটিল অসুখ নিয়ে জন্মাতে পারে, তবে সেই ভ্রূণ নষ্ট করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন মা।

Advertisement

কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বলছে, সন্তানের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে অনেক পরিবার গর্ভপাতে রাজি হলেও কাটেনি ছুতমার্গ। যেমন ষাট ছুঁই ছুঁই ব্যাঙ্ককর্মী সাহানা বিশ্বাস জানালেন, সন্তান লাভ তো ভাগ্যের ব্যাপার। একটু সমস্যা বুঝলেই তাকে জন্ম না দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিশেষ ভাল চোখে দেখেন না তিনি। এক মত বছর তিরিশের আইটি কর্মী পাপিয়া, সঞ্জয়, অর্কও। তাঁদের বক্তব্য, অনেক জটিল অসুখ তো সন্তানের জন্মের পরেও ধরা পড়ে। তখন কী করেন বাবা-মায়েরা? প্রশ্ন তুললেন তাঁরা।

তবে এই যুক্তিকে বিজ্ঞানসম্মত বলে মনে করেন না চিকিৎসকেরা। ডাক্তারদের অনেকরই মত, চিকিৎসা বিজ্ঞান এগিয়েছে অনেক। এখন আগে থেকেই জেনে নেওয়া যায়, জন্মের পরে কিছু কিছু জটিল শারীরিক বা মানসিক অসুখ হতে পারে কি না সেই শিশুর। ফলে পরীক্ষায় যদি তেমন কিছু ধরা পড়ে তো অনেক অন্তঃসত্ত্বাকে গর্ভপাতের পরামর্শ দেওয়া হয় চিকিৎসকের তরফেই। সেই মতামতে কাজও হয় বহু ক্ষেত্রে। স্ত্রীরোগ চিকিৎসক আরতি বসু সেনগুপ্ত যেমন জানান, গর্ভপাত নিয়ে ছুতমার্গ কাটেনি এখনও। এ প্রসঙ্গ উঠলে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় এখনও চিকিৎসকদের।
‘‘তবে সন্তানের ভবিষ্যৎ ভেবে চিকিৎসকদের পরামর্শ মতো ব্যবস্থা নেওয়ার প্রবণতা অনেকটাই বেড়েছে এখন।’’ বলেন তিনি।

চিকিৎসকের কথায় গুরুত্ব দেওয়ার চল বাড়ায় যে কিছুটা হলেও কেটেছে প্রয়োজনের সময়ে গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা, তা মানছেন রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়াপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, ‘‘চিকিৎসকেরা খুবই ভাল ভূমিকা নিচ্ছেন এই বিষয়ে। আমাদের দেশে গর্ভপাত সংক্রান্ত আইন যথেষ্ট আধুনিক।’’ তাই ভ্রূণে সমস্যা বুঝলে চিকিৎসকেরা দায়িত্ব নিয়ে পরামর্শ দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু মা কী চাইছেন, তা কি গুরুত্ব পাচ্ছে? সুনন্দাদেবীর সাফ উত্তর, ‘‘এতটাও সহজ হয়নি পরিস্থিতি।’’ শুধু মায়ের ইচ্ছে নয়, মায়ের শারীরিক অবস্থার কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়ার নজিরও তুলনায় এ দেশে অনেকই
কম এখনও।

চিন্তার বিষয় আছে আরও। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো গর্ভপাত করানো নিয়ে যেমন কিছুটা বেড়েছে সচেতনতা, তেমনই তার ফাঁক গলে বেড়েছে কন্যা ভ্রূণ হত্যাও। সুনন্দাদেবী মনে করাচ্ছেন, এখন থেকে সচেতন না হলে আগামী দিনে এ রাজ্যে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।

তবে পরিস্থিতি ও প্রয়োজন বুঝে কন্যা ভ্রূণ হত্যা সমন্ধে আইনও এখন কড়া বলে হয়েছে বলে জানান আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘আইন তো মানুষের কথা ভেবে তৈরি, তা পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে খানিকটা ছাড়ও দেয়। গর্ভপাত সংক্রান্ত আইনে এই প্রথম ছাড় মিলল এমন নয়, আগেও এর নজির আছে। মা-শিশুর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতাই এতে প্রাধান্য পায়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন