উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের পুরুষ মেডিসিন বিভাগের পাশেই জমে আছে জঞ্জাল। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক
এনসেফ্যালাইটিসের প্রকোপ ঠেকাতেই জেরবার স্বাস্থ্য দফতর। এই অবস্থায় হাসপাতালের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য আরও ছড়াতে পারে রোগ। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে দেখে এমনই আশঙ্কা করছেন পুণে থেকে আসা বিজ্ঞানীরা।
গোটা উত্তরবঙ্গে একমাত্র শিলিগুড়ির মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই এনসেফ্যালাইটিস নির্ণয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। সেই হাসপাতালের ওয়ার্ডের আশেপাশেই চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেখে পুণের বিজ্ঞানীরা কার্যত স্তম্ভিত। হাসপাতালের নানা ওয়ার্ডের বাইরে আবর্জনা, জল, গজ-ব্যান্ডেজ মিলে পূতিগন্ধময় অবস্থা। যথেচ্ছ ঘুরছে শূয়োর, কুকুর, বেড়াল। যা থেকে সংক্রমণ হলে অসুস্থ রোগীরা সুস্থ হওয়ার বদলে আরও বিপদে পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা ওই বিজ্ঞানীদের। হাসপাতালের ওই দূষণের কারণেই এনসেফ্যালাইটিস, ডেঙ্গি এবং ম্যালেরিয়ার সংক্রমণও হতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা।
পুণের বিজ্ঞানীরা ওই সব ছবি সম্বলিত রিপোর্ট মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষকে দিয়েছেন। তা মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার কাছে পাঠানো হবে বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। কিন্তু, প্রকাশ্যে কোনও বিজ্ঞানী মন্তব্য করতে চাননি। শনিবার পুণে থেকে আসা এক বিজ্ঞানী জানান, চার দিন আগে রিপোর্ট দেওয়া সত্ত্বেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দূষণ রোধে সে ভাবে উদ্যোগী হয়নি। সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হাসপাতালের সুপার সব্যসাচী দাস বলেন, “এ দিনই দায়িত্ব নিয়েছি। দূষণ রোধে যা করণীয় শীঘ্রই করব।”
উত্তরবঙ্গে মেডিক্যাল কলেজে এনসেফ্যালাইটিস আক্রান্তদের দেখতে গিয়েছেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। শনিবার।
শনিবারে কী দেখা গেল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে?
মেডিসিন ওয়ার্ডের পাশে দীর্ঘদিনের জমা জলের হলুদ রঙের সর পড়ে গিয়েছে। নর্দমার জলের রং গাঢ় সবুজ। জলের উপর মাছি ভনভন করছে। নদর্মার এক পাশ আগাছায় ঢাকা। তার উপরে ওয়ার্ডের জানালা। সেখানে এনসেফ্যালাইটিস আক্রান্তদের রাখা হয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসকদের একাংশই স্বীকার করেন, ওই নর্দমায় গিজগিজ করছে মশার লার্ভা। ওয়ার্ডের পিছনে মাঠে ছড়িয়ে রয়েছে চিকিৎসা-বর্জ্য। রক্তমাখা তুলো থেকে শুরু করে, ব্যবহৃত ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ, সূচ, স্যালাইন, রক্ত, লালা, প্লাস্টিকের নল থেকে শুরু করে অসংখ্য প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের যত্রতত্র ছড়িয়ে রয়েছে। দীর্ঘদিন পড়ে থেকে সেগুলির উপর নানা ধরনের পোকা জন্মেছে। মাঠে শুয়োর, কুকুর, বেড়াল ঘুরছে। ওয়ার্ডের মধ্যেও কুকুর-বেড়াল ঢুকে পড়ছে।
মশা বা অন্য কোনও মাধ্যমে রোগ যাতে না ছড়ায় সেজন্য হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতার উপরে বারবার জোর দিয়েছেন ভিন্ রাজ্য থেকে আসা বিজ্ঞানীরা। তাতে অবশ্য কাজের কাজ কিছু হয়নি। আশঙ্কা, এমন চলতে থাকলে অন্য রোগীর মধ্যেও ছড়াতে পারে সাধারণ এনসেফ্যালাইটিস। মেডিক্যালে এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে ভর্তি অনেক রোগীই মশারি পাননি। কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, শুক্রবার থেকেই মশারি বিলি শুরু হয়েছে। যদিও শনিবার দুপুরেও মশারি ছাড়াই অনেক রোগীকে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে ৪০২ জন রোগী উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে শতাধিক। শুয়োর এবং পাখির শরীর থেকে মশার মাধ্যমে জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের সংক্রমণ হয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। তবে মেডিক্যাল কলেজের যা পরিস্থিতি তাতে সাধারণ এনসেফ্যালাইটিসের সংক্রমণের আশঙ্কাও করছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা জানাচ্ছেন, সাধারণ এনসেফ্যালাইটিস জলবাহিত রোগ। ওয়ার্ডের পাশেই যেখানে দূষণের উৎস, সেখানে বাতাসে জীবাণু গিজগিজ করছে। সেই জীবাণু জল এবং খাবারের সঙ্গে রোগীর পেটে ঢুকছে।
পুণের বিজ্ঞানীদের রিপোর্টের কথা স্বীকার করেন সদ্য অপসারিত মেডিক্যাল কলেজের সুপার অমরেন্দ্র সরকার। সোমবার তিনি বলেন, “বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।” হাসপাতালের পরিবেশের প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছিলেন, “দীর্ঘদিন ধরেই পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে। তবে সাফাই অভিযান শুরু হয়েছে। চিকিৎসা বর্জ্য বাইরে ফেলতে নিষেধ করা হয়েছে।”