চিকিৎসক নেই, ধুঁকছে হাসপাতাল

দিন কয়েক আগে সীমান্তবর্তী নাথপুরে এক বাসিন্দা কীটনাশক খেয়েছিলেন। বাড়ির কাছে বানপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনও চিকিৎসক না থাকায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে কৃষ্ণগঞ্জ গ্রামীণ হাসপাতালে। সেখান থেকে ওই রোগীকে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৫ ০৩:৪৩
Share:

দিন কয়েক আগে সীমান্তবর্তী নাথপুরে এক বাসিন্দা কীটনাশক খেয়েছিলেন। বাড়ির কাছে বানপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনও চিকিৎসক না থাকায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে কৃষ্ণগঞ্জ গ্রামীণ হাসপাতালে। সেখান থেকে ওই রোগীকে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। কিন্তু অ্যাম্বুল্যান্সে তোলার আগেই মৃত্যু হয় ওই ব্যক্তির। ক্ষুব্ধ বাড়ির লোকজন কৃষ্ণগঞ্জ গ্রামীণ হাসপাতালে ভাঙচুরের পাশাপাশি চিকিৎসকদেরও মারধরও করেন বলে অভিযোগ। মৃতের পরিবারের লোকজনের দাবি, সঠিক সময় চিকিৎসা না পাওয়ায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে। বানপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক থাকলে ওই ব্যক্তি এ ভাবে মারা যেতেন না।

Advertisement

কৃষ্ণগঞ্জের নাথপুরের এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। নদিয়া জেলার বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কিংবা হাসপাতালে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে হয় রোগীর মৃত্যু হচ্ছে, না হয় তাঁদের চরম হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। তারপরে কোনও অঘটন ঘটলে কিছুদিন হইচই হচ্ছে। কিন্তু স্বাস্থ্যচিত্রের কোনও পরিবর্তন হচ্ছে না। নাথপুর এলাকার বাসিন্দা সুবোধ বিশ্বাস জানান, সীমান্তের ওই এলাকার সিংহভাগ মানুষ খুব গরিব। চিকিৎসার ক্ষেত্রে তাঁরা সরকারি হাসপাতালের উপরে নিভর্রশীল। কিন্তু স্বাস্থ্যকেন্দ্র কিংবা হাসপাতালে যদি চিকিৎসকই না থাকে তাহলে লোকজন যাবেন কোথায়? তিনি বলেন, ‘‘সরকার এখন উপরটা ঝকঝকে রাখছে। যাতে মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কিন্তু স্বাস্থ্য পরিষেবা একেবারেই ভেঙে পড়ছে।’’

বানপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শয্যা সংখ্যাও ১০ টি। সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী চিকিৎসক থাকার কথা দু’জন। কিন্তু এই মুহূর্তে একজনও চিকিৎসক নেই। ফলে সামান্য জ্বর হলেও ওই এলাকার দরিদ্র মানুষকে মানুষদের ছুটতে হচ্ছে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে কৃষ্ণগঞ্জ গ্রামীণ হাসপাতালে। এমন অবস্থা শুধু এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রেরই নয়, জেলার মোট ৪৯টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মধ্যে ১০টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজনও চিকিৎসক নেই। জেলায় প্রায় ৬টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে যেখানে চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র একজন। সেখান থেকে রোগীদের অন্যত্র পাঠানো হচ্ছে যেখানে সেই গ্রামীণ হাসপাতালগুলির অবস্থাও তথৈবচ।

Advertisement

কৃষ্ণগঞ্জ গ্রামীণ হাসপাতালের কথাই ধরা যাক। এই হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ৩০টি। সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী চিকিৎসক থাকার কথা ৬ জন। কিন্তু বর্তমানে সেখানে চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র দু’জন। ফলে এখান থেকেও রোগীকে রেফার করে দেওয়া হচ্ছে জেলা সদর হাসপাতালে। হাসপাতালের সুপার স্বাতী কুণ্ডু বলেন, ‘‘চিকিৎসকের অভাবে ব্লকের তিনটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে রোগীদের এখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসক কম রয়েছেন এখানেও। ফলে এই বিরাট রোগীর চাপ সামাল দিতে আমাদেরও হিমশিম খেতে হয়।’’

জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, নদিয়া জেলার বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে যে সংখ্যক চিকিৎসক থাকার কথা তার প্রায় এক তৃতীয়াংশ চিকিৎসক নেই। এই মুহূর্তে সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী জেলায় মোট চিকিৎসক থাকার কথা ৩৭৪ জন। কিন্তু চিকিৎসক আছেন ২২৫ জন। আর চিকিৎসকের এই ঘাটতির কারণে জেলার সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরিষেবা ধুঁকছে। যেমন তেহট্ট মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসক থাকার কথা ২৪ জন। কিন্তু চিকিৎসক আছেন মাত্র ১২ জন। সীমান্ত লাগোয়া এই মহকুমা হাসপাতালে শুধুমাত্র চিকিৎসকের অভাবে সপ্তাহে তিন দিনের বেশি সিজার করা সম্ভব হয় না। অন্যান্য অস্ত্রোপচার পুরোপুরি বন্ধ। ফলে তেমন কোনও রোগী এলেই জেলা হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়াই এই হাসপাতালের দস্তুর।

আর এ ভাবেই জেলা হাসপাতালে রোগীর চাপ মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়েই চলেছে। জেলা সদর হাসপাতালে প্রসূতি বিভাগে শয্যা সংখ্যা ৯৫টি। কিন্তু সেখানে গড়ে প্রায় ২৫০ জন করে রোগী ভর্তি থাকেন। জেলার হাসপাতাল ও জনস্বাস্থ্য রক্ষা কমিটির সম্পাদক দেবাশিস চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আমাদের রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবা আসলে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকতে বলার মতো। সর্বত্র বড় বড় ভবন তৈরি করা হচ্ছে। খোলা হচ্ছে বিভিন্ন নতুন বিভাগও। কিন্তু উপযুক্ত সংখ্যক চিকিসৎকের অভাবে মানুষ পরিষেবা পাচ্ছে না। শহরের থেকে গ্রামীণ এলাকার অবস্থা আরও খারাপ।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘বর্তমান সরকার কথায় কথায় ৩৪ বছরের কথা বলে। কিন্তু এই সরকারের আমলেও তো স্বাস্থ্য পরিষেবার কোনও পরিবর্তন চোখে পড়ছে না।’’

জেলার স্বাস্থ্য দফতরে কর্তারাও তাঁদের ঘনিষ্ঠ মহলে স্বীকার করছেন যে, এ ভাবে জোড়া তালি দিয়ে বেশি দিন গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। দ্রুত পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে গোটা স্বাস্থ্য পরিকাঠামোটাই ভেঙে পড়বে। পরিষেবা না পেয়ে সাধারণ মানুষ যেমন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন, তেমনই কিন্তু দিনের পর দিন কাজের চাপ নিতে নিতে বিদ্রোহী হয়ে উঠছেন চিকিৎসকেরাও। পরিস্থিতির কথা স্বীকার করে নিয়েছেন রাজ্যের শাসক দলের জনপ্রতিনিধিরাও। কৃষ্ণগঞ্জ পঞ্চায়েত সমিতির স্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ চন্দন বিশ্বাস বলেন, ‘‘আমাদের ব্লকের তিনটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই কোনও চিকিৎসক নেই। ফলে গ্রামের মানুষকে চরম হয়রান হতে হচ্ছে। তাঁরা ঠিক মতো চিকিৎসা পাচ্ছেন না। বিষয়টি নিয়ে আমরা একাধিক বার জেলার স্বাস্থ্য কর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। দ্রুত এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে চিকিৎসক দেওয়ারও আবেদন করেছি। কিন্তু কোনও ফল হয়নি।’’

নদিয়া জেলা পরিষদের জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ কর্মাধ্যক্ষ তৃণমূলের হরিদাস প্রামাণিকও বলেন, ‘‘এটা ঠিক যে চিকিৎসকের অভাবে আমাদের জেলায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতালগুলিতে সমস্যা হচ্ছে। রোগী কল্যাণ সমিতির সভায় আলোচনা করে আমরা মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠিও দিয়েছি।’’আর জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তাপস রায় বলেন, ‘‘চিকিৎসকের অভাব আছে। আমরা স্থাস্থ্য দফতরকেও বিষয়টি জানিয়েছি। আশা করছি কিছু দিনের মধ্যেই এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’’

কিন্তু সাধারণ মানুষ তো অনেক দূরের কথা, এমন আশ্বাসে বিশেষ ভরসা পাচ্ছেন না বহু হাসপাতাল কতৃপক্ষই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন