খুকখুকে কাশি, ঘুষঘুষে জ্বর? কী বলছেন চিকিত্সকরা

শীত গিয়ে বসন্ত আসি-আসি। সেই সঙ্গে এসেছে কাশি। প্রায় প্রতিটি ঘর থেকে কখনও টানা বা দমক-দমক কাশির আওয়াজ। মধুমাসে বদখত কাশিতে বাঙালি জেরবার। লিখেছেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সৌমেন ভট্টাচার্য।শীত গিয়ে বসন্ত আসি-আসি। সেই সঙ্গে এসেছে কাশি। প্রায় প্রতিটি ঘর থেকে কখনও টানা বা দমক-দমক কাশির আওয়াজ। মধুমাসে বদখত কাশিতে বাঙালি জেরবার।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:৪০
Share:

ছবি প্রতীকী। তুলেছেন প্রণব দেবনাথ

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বেশির ভাগ বাড়ি যেন ‘কাশি ধাম’! পরিবারের আট বা আশি—কেউই কাশির আক্রমণের বাইরে নন। ওষুধ, সিরাপ, টোটকা, অ্যান্টিবায়োটিক, গার্গল, ভেপার কিছুতেই কাজ হচ্ছে। রাত যত বাড়ছে ততই চড়ছে কাশির মাত্রা। কিন্তু রোগ সারছে কই?

Advertisement

মনে রাখতে হবে, কাশি নিজে কোনও রোগ নয়। রোগের লক্ষণ মাত্র। শারীরিক, মানসিক, পরিবেশ গত নানাকারণে সৃষ্টি হয় কাশির। এমনকি বয়ঃসন্ধিও কখনও কখনও কাশির কারণ হতে পারে। গ্যাস থেকেও কাশি হয়। স্থায়িত্ব অনুযায়ী কাশিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। তিন সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী কাশিকে বলা হয় অ্যাকিউট কাশি। তিন থেকে আট সপ্তাহ পর্যন্ত কাশি স্থায়ী হলে তাকে বলা হয় সাব-অ্যাকিউট কাশি। আর আট সপ্তাহের বেশি কাশি হলে তাকে বলা হয় ক্রনিক কাশি।

কাশি কী কী কীরণে হয়? ঠান্ডা লাগা ছাড়াও চিকিৎসা বিজ্ঞানে কাশির অজস্র কারণ আছে। এর মধ্যে প্রধান কারণ চারটি। ১) ইনফ্লামেটরি বা প্রদাহ জনিত কাশি। মূলত শ্বাসনালী বা ফুসফুসে রক্ত চলাচল বেড়ে গিয়ে এই কাশির সৃষ্টি। ল্যারেনজাইটিস অথবা ফ্যারেনজাইটিস জাতীয় রোগ এই ধরনের কাশির জন্য দায়ী। ২) মেকানিক্যাল অর্থাৎ বাইরে বা ভিতর থেকে তৈরি হওয়া কোনও চাপের ফলে সৃষ্ট কাশি। ধরা যাক, শ্বাসনালীর ভিতরে কোনও টিউমার হয়েছে। তার চাপে কাশি হতে পারে। হৃদরোগের জন্য কাশিও একই পর্যায়ের। ৩) কেমিক্যাল অর্থাৎ সিগারেট, বিড়ি বা কোনও তামাক জাতীয় বস্তু গ্রহণ করার জন্য কাশি। যে কোনও গ্যাস যেমন, গাড়ির পোড়া কার্বন কিংবা ক্লোরিনের ঝাঁজালো গ্যাস অথবা কোনও কিছু পোড়া বস্তু থেকে বের হওয়া ধোঁয়ার কারণে হওয়া কাশি এর উদাহরণ। ৪) থার্মাল – আবহাওয়া। হঠাৎ ঠাণ্ডা বা গরমের মধ্যে যাতায়াতের ফলে সৃষ্ট কাশি এর উদাহরণ। ঋতু পরিবর্তনের সময় এখন যে কাশি চারিদিকে মানুষের হচ্ছে, তা এই ধরনের কাশির

Advertisement

মধ্যে পড়ে।

চরিত্রগত ভাবে অবশ্য কাশি দু রকমের। ড্রাই বা শুকনো কাশি আর প্রোডাকটিভ বা কফ উৎপাদক কাশি। শুকনো কাশি হয় টিবির প্রথম অবস্থায়। এ ছাড়া ল্যারেনজাইটিস, ফ্যারেনজাইটিস বা ট্রাকিয়াটাইটিস হলে এই ধরনের কাশি হয়। আলজিভ বড় হলেও এই কাশি হয়। অত্যন্ত বিরক্তিকর এই কাশির চরিত্র। সর্বক্ষণ কাশতে থাকেন রোগী। রাতের দিকে কাশির তীব্রতা বাড়ে। ঋতু পরিবর্তনের ময়ে গলার রোগে নিয়মিত ভোগেন এমন মানুষদের এই ধরনের কাশি হয়।

অন্য দিকে, কফ উৎপাদক কাশির ক্ষেত্রে কফের পরিমাণ, রঙ, গন্ধ এবং সময় বিচার করে কাশির কারণ চিহ্নিত করেন চিকিৎসকেরা। কাশির সঙ্গে পুঁজের মতো কফ হলে বুঝতে হবে রোগীর ফুসফুসে ফোঁড়া হয়েছে। যদি কফের রঙ হলদেটে হয় বুঝতে হবে সংক্রমণ জনিত কাশি। কালচে বা ধূসর রঙের হলে বুঝতে হবে, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বাতাসের ধুলোময়লা ঢুকে সংক্রমণ হয়ে কাশি হচ্ছে। লালচে-কালো রঙের কফ হলে বুঝতে হবে নিউমোনিয়ার জন্য কাশি হচ্ছে। কফের রঙ যদি গোলাপি হয় তা হলে কাশির কারণ ফুসফুসে জল জমা। শরীরের অবস্থানগত কারণে কাশির হ্রাসবৃদ্ধি হলে যেমন ডান দিকে পাশ ফিরে শুলে যদি বেশি কাশি হয়, তখন বুঝতে হবে ফুসফুসে সমস্যা অথবা ব্রঙ্কাইটিস থেকে কাশি হচ্ছে। পাঁজরের হাড় ভেঙে গেলেও কাশি হয়।

মানসিক কারণেও কাশি হতে পারে। নিজের উপস্থিতি জানাতে অনেকেই কাশির স্মরণাপন্ন হন। সর্বোপরি অ্যালার্জি জনিত কাশি হয়। বহুমানুষ আছেন যাঁদের ঋতু পরিবর্তনের সময় অ্যালার্জি জনিত কারণে কাশি হয়। সেই অ্যালার্জি ঠান্ডা থেকে, ধুলোবালি থেকে, ময়লা থেকে, ফুলের রেণু ইত্যাদি নানা কারণে হতে পারে। এই ক্ষেত্রে ঘন ঘন আবহাওয়ার বদল, ঠান্ডা গরমের দ্রুত যাওয়া আসা থেকে ওই জাতীয় কাশির জন্ম। এই ক্ষেত্রে কাশি একই সময়ে বহু মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সর্দি, ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং কাশির ত্র্যহস্পর্শে গ্রাম থেকে শহর নাজেহাল হয়ে যায়।

ঋতু পরিবর্তনের এই সময়ে নিজেকে ঠান্ডা লাগা থেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। বিশেষ করে শিশু এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রে আবহাওয়ার এই বদল মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। সাধারণ সর্দি, কাশি, জ্বরের পাশাপাশি উপরে আলোচিত জটিল নানান অসুখও আক্রমণ শানাতে পারে। সদ্যজাত শিশুর দেহ অথবা অশক্ত বৃদ্ধের শরীর পারে না এই ছন্দপতনের সঙ্গে তাল মেলাতে। ফলে চট করে ঠান্ডা লাগার শিকার হয়ে পড়েন। তাঁদের গরম পোশাক দিয়ে শরীর ঢেকে রাখতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যে সময় তাপমাত্রা চড়ে গিয়েছে সেই সময় বেশি জামাকাপড়ের কারণে যেন ঘাম বসে না যায়।

অর্থাৎ তাপমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জামাকাপড় পড়তে হবে। যাঁদের অ্যালার্জির ধাত তাঁদের ধুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। যারা সিগারেট বা তামাক জাত দ্রব্য গ্রহণ বন্ধ করতে হবে। রোদে বা গরমে শরীর ঘেমে গেলেও এখনই এসি ব্যবহার নয়। ভিজে জামা খুলে গা মুছে পোশাক বদলে নিন। এখনই রাতে মাথার দিকে জানলা খুলে ঘুমোবেন না। গায়ে চাদর রাখতে হবে। কারণ, রাত যত বাড়বে ততই তাপমাত্রা কমবে। উষ্ণ গরম জলে স্নান করুন। খুব সকালে বা রাতে স্নান না করাই ভালো। যাঁদের ঠান্ডার ধাত তাঁরা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন নিতে পারেন। এটি পাঁচ বছর অন্তর নিতে হয়। আবার প্রতি বছর নেওয়ার জন্য ভ্যাকসিনও আছে।

অনুলিখন: দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন