কিশোরীর পেট থেকে মিলল পাঁচ কেজির টিউমার!

ক্লাস নাইনের পিয়া দাস খেতে পারত না মোটে। এক গ্রাস ভাত কিংবা আধখানা রুটি খেয়েই নাকি পেট ভরে যেত মেয়ের। জোর করে খাওয়াতে গেলেই কান্নাকাটি, সঙ্গে বমি। একদিন শুরু হল পেটে অসহ্য যন্ত্রণা। শেষে অস্ত্রোপচার করে তার পেট থেকে বের করা হল প্রায় পাঁচ কিলো ওজনের এক টিউমার! হতবাক পিয়ার পরিজনেরা, চিকিৎসকেরাও।

Advertisement

সৌভিক চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৫ ১৪:৫২
Share:

অস্ত্রোপচারের পরে পিয়া দাস। —নিজস্ব চিত্র।

ক্লাস নাইনের পিয়া দাস খেতে পারত না মোটে। এক গ্রাস ভাত কিংবা আধখানা রুটি খেয়েই নাকি পেট ভরে যেত মেয়ের। জোর করে খাওয়াতে গেলেই কান্নাকাটি, সঙ্গে বমি। একদিন শুরু হল পেটে অসহ্য যন্ত্রণা। শেষে অস্ত্রোপচার করে তার পেট থেকে বের করা হল প্রায় পাঁচ কিলো ওজনের এক টিউমার! হতবাক পিয়ার পরিজনেরা, চিকিৎসকেরাও।

Advertisement

পিয়ার মামা প্রদীপ নাথ জানান, মাস ছ’য়েক ধরেই পিয়ার তলপেটে অস্বস্তি হত। শেষের তিন মাস পিয়া প্রায় কিছুই খেত না। মেয়ের মুখে রুচি নেই ভেবে রকমারি পদ রান্না করতেন পিয়ার মা মায়া দাস। কিন্তু সে সবও খুঁটে খুঁটে খেয়ে সরিয়ে দিত পিয়া। স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে বিভিন্ন হজমের ওষুধ খাইয়েও কোনও লাভ হয়নি। ওজন কমে যাচ্ছিল হু হু করে। এর মধ্যেই একদিন বাড়িতে পড়ে যায় পিয়া। তারপরেই বাড়তে থাকে পেটে যন্ত্রণা।

প্রদীপবাবু জানাচ্ছেন, স্থানীয় চিকিৎসক প্রথমে গ্যাসের ব্যথা ভেবে ইঞ্জেকশন দেন। কিন্তু ব্যথা বাড়তেই থাকে। বেগতিক দেখে পিয়াকে ভর্তি করা হয় ইএসআই জোকায়। এক্স রে করে দেখা যায় পিয়ার পেটের ভিতর একটি বেশ বড় মাংসপিণ্ড রয়েছে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় পিয়াকে ভর্তি করা হয় ইএম বাইপাসের এক বেসরকারি নার্সিংহোমে। সেখানেই এক জটিল অস্ত্রোপচারের পর সুস্থ হয় পিয়া।

Advertisement

কী হয়েছিল পিয়ার?

গ্যাস্ট্রো এবং এইচপিবি (হেপাটো প্যাংক্রিয়াটিকো বিলিয়ারি) সার্জেন শুদ্ধসত্ত্ব সেন জানাচ্ছেন, পিয়ার লিভারের বাম খণ্ডে একটি বিরাট টিউমার হয়েছিল এবং সেটির ভিতরে ক্রমাগত রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। ডাক্তারি পরিভাষায় এর নাম ‘হেপাটিক প্রাইমারি আনডিফারেনশিয়েটেড এমব্রায়োনাল সারকোমা’ (যকৃতের এক বিশেষ এবং অস্বাভাবিক ক্যানসার)। বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৪ বছরের মেয়ের এই ধরনের ক্যানসার বিরল তো বটেই, রীতিমতো অস্বাভাবিক।

এই সেই টিউমার।

শুদ্ধসত্ত্ব বাবু বলছেন, “সিটি স্ক্যান করে প্রথমে এই টিউমারটিকে ‘হেপাটোব্লাস্টোমা’ ভাবা হয়েছিল। কিন্তু পরে দেখা যায় পিয়ার সমস্যা আরও জটিল। টিউমারটি অনেক দিন ধরেই বাড়তে বাড়তে পিয়ার পুরো পেটের দখল নিয়ে নিয়েছিল। পাকস্থলী এবং অন্ত্রের ওপর ভয়ানক চাপ সৃষ্টি করেছিল। তাই সামান্য খেলেই পেট ভরে যেত পিয়ার। অস্ত্রোপচার ছাড়া পিয়াকে বাঁচানোর উপায় ছিল না। তবে রীতিমতো কঠিন ছিল কাজটা। আমরা নিজেরাও বেশ সংশয়ে ছিলাম। সে কারণেই আমরা ২৪ বোতল রক্ত জোগাড় করে রেখেছিলাম। কারণ বেশি রক্তপাত হলেই পিয়ার হার্ট ফেল করার সম্ভাবনা ছিল।’’

নার্সিংহোম সূত্রে খবর, অস্ত্রোপচারের পর পিয়ার পেট থেকে বের করা হয় প্রায় পাঁচ কিলো ওজনের টিউমারটি। সব মিলিয়ে ৯০টি সেলাই পড়ে। যদিও প্রথমে ২৪ বোতল রক্ত এনে রাখা হয়েছিল, কিন্তু সে সবের দরকার পড়েনি। তবে যকৃতে এত বড় টিউমারের কথা এর আগে শুনেছেন বলে মনে করতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা।

কিন্তু কেন হয় এই ধরনের টিউমার?

চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরি জানাচ্ছেন, যকৃৎ ব্যাপারটাই খুব গোলমেলে। মানব দেহের যত আদিম কোষগুলির ঘাঁটি ওখানেই। তাই সঠিক কারণ নির্ণয় করা বেশ মুশকিল। তিনি বলেন, ‘‘এই ধরনের অসুখে রোগ নির্ণয় করাটাই বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। লিভার যতক্ষণ ভাল তো ভাল, কিন্তু খারাপ হলেই মুশকিল।’’

একই মত শুদ্ধসত্ত্ববাবুরও। তিনি জানাচ্ছেন, ‘হেপাটোব্লাস্টোমা’ সাধারণত তিন—চার বছরের বাচ্চাদের হয়। আর ১৪ বছর বয়সে ‘এমব্রায়োনাল সারকোমা’ তো আরও বিরল। কারণ মানুষের দেহে ভ্রূণাবস্থায় যে কোষগুলি থাকে সেগুলি পরে সুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু পিয়ার ক্ষেত্রে সেই কোষগুলি থেকেই টিউমারটি হয়েছিল। শুদ্ধসত্ত্ববাবু বলেন, ‘‘ক্যানসার সাধারণত রক্ত বা লসিকার মাধ্যমে দেহের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। পিয়ার টিউমারটির আকার খুব বড় হলেও এটি এক জায়গাতেই ছিল, ছড়িয়ে পড়েনি। তাই আমাদের কাজ কিছুটা হলেও সহজ হয়েছে। ছড়িয়ে পড়লে মুশকিল হত।’’

অস্ত্রোপচারের চার দিন পরেই নার্সিংহোম থেকে ছাড়া পেয়েছে পিয়া। এখন অনেকটাই সুস্থ সে। বই পত্র নিয়ে বসছে। সবচেয়ে বড় কথা দিন কয়েক আগে রবিবারের এক সকালে সে মায়া দেবীকে বলেছে, ‘‘মা, আর একটা লুচি দাও তো।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন