মোবাইল ছাড়া খায় না খুদে। এমন আসক্তির ফল কী? ছবি: এআই সহায়তায় প্রণীত।
৪ বছরের টিটো। বেড়াতে গিয়ে খাওয়ার সময় কান্নাকাটি। তাঁর মা জানালেন, ওয়াইফাই ঠিকমতো কাজ করছে না। কার্টুন না দেখে ছেলে নাকি খায় না!
৩ বছরের দীপশিখা। খাওয়া নিয়ে বায়নাক্কা প্রচুর। খাওয়ানোর নামে যুদ্ধ চলে, মায়ের অভিযোগ। তবে মোবাইল দিলে কিছুটা তো খায়!
বেসরকারি সংস্থায় কর্মরতা রচনার কথায়, “মোবাইল হাত থেকে কেড়ে নিলে, বা স্ক্রিন টাইম কমালেই কি কাজ হয় না কি! যাঁরা সন্তান সামলান, তাঁরা জানেন বিষয়টা কতটা কঠিন।”
বয়সের ফারাক রয়েছে কিছুটা। প্রতিটি শিশু বিভিন্ন আবহে বড় হচ্ছে। কারও মা গৃহবধূ, কারও মা চাকরিজীবী। তবে সকলের মধ্যেই একটি প্রবণতা সাধারণ, প্রত্যেকটি শিশুই খাওয়ার সময় মোবাইল নির্ভর। আর তাদের মায়েদের বক্তব্য, না খেতে দিলেও খাওয়ার কথা মুখে আনে না। কিছু খাওয়ালে গালে নিয়ে বসে থাকে। শেষে হার মেনে উঠে গিয়ে মোবাইল দিতে হয়।
মোবাইল দেখিয়ে সন্তানকে খাওয়ানোর চল যে ঘরে ঘরে, একটু নজর করলেই এমন ছবি চোখে পড়ে। মোবাইলের প্রতি এই আসক্তি নিয়েই চিন্তিত চিকিৎসক থেকে মনোবিদ, মনোরোগ চিকিৎসকেরা। গান, কার্টুন, রিল চললেই তারা খাবে। আর বিনোদন বন্ধ হলেই চিৎকার, চেঁচামেচি, কান্না, বায়না।
পেরেন্টিং কনসালট্যন্ট থেকে মনোবিদদের প্রশ্ন, এ ভাবে কি শিশু আদৌ খেতে শেখে? না কি তাকে খাইয়ে দেওয়ার কথা? মনো-সমাজকর্মী মোহিত রণদীপ বলছেন, ‘‘এ ভাবে না কোন শিশু খাবারের স্বাদ বোঝে, না তার পুষ্টিগুণ জানে। অভিভাবকেরা কার্যত মোবাইল দেখিয়ে তাদের খাবারটি গলাধঃকরণ করান।’’
সমস্যা কোথায়?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের পরিসংখ্যানে ভারতে ৫ বছরের কম বয়সি সাড়ে তিন লক্ষ শিশু স্থূলত্বের শিকার।
মনোবিদেরা জানাচ্ছেন, সমস্যা হল, মোবাইল দেখতে দেখতে শিশু যখন খায়, সে অন্য কোনও বিষয়ে মগ্ন হয়ে থাকে। ফলে কী খাচ্ছে, কতটা খাচ্ছে খেয়ালই থাকে না। অনেক সময় শিশু খেয়ে নিচ্ছে বলেই অভিভাবকেরা খাইয়ে যান। এতে অভিভাবকদের সুবিধা হলে, তা থেকে স্থূলত্বের মতো সমস্যা হয়। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে বিশ্বজুড়ে শিশুদের স্থূলত্বের সমস্যা চরম আকার ধারণ করছে। ভারতও পিছিয়ে নেই।
‘‘সচেতন ভাবে খেলে তবেই কিন্তু শিশু বুঝবে তার পেট ভরল কি না। খাওয়া বেশি হলে, সে নিজে থেকেই হাত সরিয়ে দেবে। সেই ইঙ্গিত যদি অভিভাবকেরা অবহেলা করেন, সমস্যা হবে তখনই’’, বলছেন মোহিত।
বাস্তবসম্মত সমাধানের পথ কী?
শিশুদের স্ক্রিন টাইম বেঁধে দেওয়া দরকার। খাওয়ার সময়ে মোবাইল দেওয়া যাবে না। এমন পরামর্শই মেলে। তবে কোনও কোনও মায়ের যুক্তি, এই সব তত্ত্বকথা। বাস্তবে মানা বেশ কঠিন।
মোহিত বলছেন, ‘‘একটু বেশি খাওয়ানোর চেয়ে মোবাইলে আসক্তি কতটা ক্ষতিকর অভিভাবকেরা সচেতন হলে, তাঁরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন কোনটা করণীয়।’’
মনো-সমাজকর্মীর পরামর্শ—
· খাওয়ানোর সময় মোবাইল দেওয়া, টিভি দেখিয়ে খাওয়ানো সমাধান নয়। বরং সে যদি খুব কমও খায়, সেটুকু মেনে নেওয়া দরকার।
· শিশুর অন্যায্য বায়নায় মদত দিলে, ভবিষ্যতে তা তার জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে। চিকিৎসকেরা বলেন, খিদে পেলে সে নিজে খাবে। তার খিদে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করা জরুরি। বুঝতে হবে, তার খেতে না চাওয়ার কারণ কী।
· স্বাদ এবং খাবারের বৈচিত্র খুব জরুরি। শিশুরা রংচঙে জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হয়। অমলেট থেকে ভাত, রুটি— যেটাই দেওয়া হোক না কেন, রান্নায় ভাবনা দরকার। ডিমের পোচও গাজর, আঙুর দিয়ে চোখ-নাক তৈরি করে সাজানো যায়। পালংশাক, ধনেপাতা বা শাক দিয়ে ছোট সবুজ রুটি করা যায়। একই সঙ্গে জরুরি স্বাদও।
· রান্না করার সময় খুদেকে সঙ্গে রাখতে পারেন। কী রান্না হচ্ছে, কী করে হচ্ছে, তাকে দেখালে সে-ও কিন্তু কৌতূহলী হবে। রান্না করা খাবারের স্বাদ পাওয়ার আগ্রহ তৈরি করা যায় এই ভাবেও।
· মাটির সব্জি, বইয়ের পাতায় সব্জির ছবি দেখিয়ে তাকে জিনিসটির প্রতি উৎসাহী করা যায়। সেই সব্জির পুষ্টিগুণ তার মতো করে বুঝিয়ে সেটি রান্না করে দিলে, শিশু কৌতূহলী হতে পারে।
· একলা শিশুকে না খাইয়ে তার সঙ্গে যদি বড়রা খান, সেই খাবারটির প্রশংসা করেন, তা হলেও কাজ হতে পারে।