নিষিদ্ধ পদ্ধতিতে ডেঙ্গি-পরীক্ষা, তার রিপোর্টও উধাও

সরকারি হাসপাতালে প্রায় ২০০ জন রোগীর ডেঙ্গি পরীক্ষা হল। অথচ তাতে কী পাওয়া গেল, তার রিপোর্ট পৌঁছল না স্বাস্থ্য ভবনে! ‘ভ্যানিশ’ হয়ে যাওয়া সেই রিপোর্ট নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরে। কলকাতা ও তার আশপাশে ডেঙ্গি-আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা আড়াল করতে কেউ বা কারা ইচ্ছাকৃত ভাবে এই কাজ করেছেন কি না, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:১৫
Share:

সরকারি হাসপাতালে প্রায় ২০০ জন রোগীর ডেঙ্গি পরীক্ষা হল। অথচ তাতে কী পাওয়া গেল, তার রিপোর্ট পৌঁছল না স্বাস্থ্য ভবনে! ‘ভ্যানিশ’ হয়ে যাওয়া সেই রিপোর্ট নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরে। কলকাতা ও তার আশপাশে ডেঙ্গি-আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা আড়াল করতে কেউ বা কারা ইচ্ছাকৃত ভাবে এই কাজ করেছেন কি না, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী।

Advertisement

ঘটনাস্থল: কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, গত ২২ অগস্ট ওই হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ ডেঙ্গি পরীক্ষার জন্য দু’টি ‘নন-স্পেসিফিক ১ (এনএস১) র‌্যাপিড কিট’ কেনার রিক্যুইজিশন দেয় হাসপাতালের ফার্মাসিতে। ওই এক-একটি কিটে ১০০ জনের পরীক্ষা হয়। হাসপাতাল সূত্রে খবর, ২৪ অগস্ট কিট আসে এবং তা দিয়ে মূলত আউটডোরে ডেঙ্গির মতো উপসর্গ থাকা রোগীদের রক্ত পরীক্ষা হয়।

চার দিনের মধ্যে দু’টি কিট শেষ হয়ে যায়। ২৯ অগস্ট মাইক্রোবায়েলজি বিভাগ আবার একটি এনএস-১ র‌্যাপিড কিট কেনার রিক্যুইজিশন পাঠায়। তখন টনক নড়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। তাঁরা দেখেন, আগের দু’টি কিটে ২০০ জনের ডেঙ্গি পরীক্ষার কোনও রিপোর্ট রেজিস্ট্রারের কাছে জমা দেয়নি মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ। স্বাস্থ্য ভবনে ওই জরুরি রিপোর্ট পাঠানোও যায়নি। ফলে, পরবর্তী এনএস-১ র্যাপিড টেস্ট কিট কেনা আটকে দেওয়া হয়।

Advertisement

সপ্তাহখানেক আগে এই ঘটনা জানাজানি হতেই স্বাস্থ্য ভবনে শোরগোল পরে যায়। প্রথমত, সরকারি জায়গায় র‌্যাপিড কিটের মাধ্যমে ডেঙ্গি পরীক্ষা অনেক দিন আগেই নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। এলাইজা বা আইজিএম পদ্ধতিতে ডেঙ্গি পরীক্ষাই একমাত্র স্বীকৃত। সেখানে মেডিক্যাল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ কী করে ডেঙ্গি পরীক্ষায় র্যাপিড কিট ব্যবহার করল, সেই প্রশ্ন উঠেছে। আরও বড় প্রশ্ন, যদিও বা ২০০ জনের র‌্যাপিড টেস্ট হল, তা হলে ওই রিপোর্ট কেন স্বাস্থ্য ভবনে গেল না? এর ফলে পতঙ্গবাহিত রোগ সম্পর্কে তথ্য গোপনের গুরুতর অভিযোগ উঠছে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের বিরুদ্ধে।

মাইক্রোবায়োলজির প্রধান মণিদীপা সেনগুপ্ত অবশ্য যুক্তি দিয়েছেন, “র‌্যাপিড পদ্ধতিতে পরীক্ষা সরকারি জায়গায় নিষিদ্ধ জানি। কিন্তু রোগী বা তাঁর বাড়ির লোক রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে চান না। দ্রুত রিপোর্টের জন্য চাপ দেন। র্যাপিড কিটের মাধ্যমে পরীক্ষায় এলাইজা পদ্ধতির থেকে তাড়াতাড়ি রিপোর্ট পাওয়া যায়। তাই রোগীদের চাপেই র্যাপিড কিটে পরীক্ষা হয়েছে কয়েক জনের।” তাঁর আরও বক্তব্য, “এলাইজা কিটের ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যাক রক্তের নমুনা না পাওয়া পর্যন্ত পরীক্ষা শুরু করা যায় না। যথেষ্ট সংখ্যাক রক্তের নমুনা পেতে পাঁচ-ছ’দিন লেগে যায়। রোগীরা তত দিন অপেক্ষা করতে চান না। তাই র‌্যাপিডে পরীক্ষা করেছি।”

কিন্তু পরীক্ষার পর সেই রিপোর্ট স্বাস্থ্য দফতরে পাঠানো হয়নি কেন?

মণিদীপাদেবী দাবি করেন, “সরকারি ভাবে র‌্যাপিড কিটে পরীক্ষা নিষিদ্ধ, তাই ওই রিপোর্ট পাঠাইনি। কিন্তু ওই সব রক্তের নমুনা আমরা সংরক্ষণ করে রেখেছিলাম। পরে সবগুলি আবার এলাইজা পদ্ধতিতে পরীক্ষা হয়েছিল। সেই রিপোর্ট স্বাস্থ্য দফতরে পাঠিয়েছি।”

প্রশ্ন উঠেছে, যে নমুনাগুলির র‌্যাপিড পরীক্ষা হয়েছে, সেগুলিরই যে পরে এলাইজা পদ্ধতিতে পরীক্ষা হয়েছে, তার কী প্রমাণ রয়েছে? কোথায় নথিভুক্ত রয়েছে? এর প্রমাণ এখনও স্বাস্থ্য দফতরে জমা দিতে পারেনি মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ।

ক্ষুব্ধ স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর কথায়, “র‌্যাপিড কিটে ডেঙ্গি পরীক্ষা করলে ৭০-৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে রিপোর্ট ভুল আসার কথা। কোন যুক্তিতে স্বাস্থ্য ভবনকে অন্ধকারে রেখে একটা মেডিক্যাল কলেজ এই পদ্ধতিতে ডেঙ্গি পরীক্ষা করতে পারে?” তাঁর বক্তব্য, “ওই রোগীরা কোন অঞ্চল থেকে কী উপসর্গ নিয়ে এসেছিলেন, কিচ্ছু জানা গেল না। তাঁরা আদৌ ঠিক রিপোর্ট পেলেন কি না, পরে সত্যিই তাঁদের আবার এলাইজা পরীক্ষা হয়েছে কি না, হয়ে থাকলে তাঁরা প্রত্যেকে সেই রিপোর্ট জেনেছেন কি না, তাঁদের সঠিক চিকিৎসা হয়েছে কি না সব কিছু নিয়েই ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। এই গাফিলতি বরদাস্ত করা হবে না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন